Skip to content

Latest commit

 

History

History
120 lines (61 loc) · 22.4 KB

সমাপতন-নন্দিতা-বাগচী.md

File metadata and controls

120 lines (61 loc) · 22.4 KB

সমাপতন

নন্দিতা বাগচী


নতুন উপন্যাসটা শুরু করেছি মাস দেড়েক আগে। উপন্যাসের কথায় আসার আগে বলি, মাঝখানে উপন্যাস লেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কেমন একটা আতঙ্ক গ্রাস করেছিল যেন আমাকে। তাই কিছু ছোটগল্প আর রম্যরচনা লিখছিলাম মনটাকে প্রকৃতিস্থ করার জন্য। কিন্তু প্রকাশক তাগাদা দিচ্ছেন আবার। বলছেন, “আপনার উপন্যাস হল আমাদের লক্ষ্মী। কেন শুধু শুধু আমাদের বঞ্চিত করছেন? এতে তো আপনারও লস।”

আমি মিথ্যে কথা বলি, “লেখা আসছে না একেবারেই। রাইটার’স ব্লক হয়ে গেল কিনা কে জানে।”

প্রকাশক হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, “দূর মশাই! আপনি হলেন সরস্বতীর বরপুত্র, আপনার কেন হবে ও সব? বরং ক’টা দিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসুন, মনটা ফ্রেশ হয়ে যাবে। নতুন নতুন আইডিয়া আসবে তখন মাথায়। তার পর তরতর করে এগিয়ে যাবে পানসি।”

আমি আর কোথায় যাব? একা মানুষ, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই বললেই চলে। লেখালিখি করতে এসে বড়ই ঘরকুনো হয়ে গেছি। তবে নিঃসঙ্গ বোধ করি না। আমার গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররাই আমায় ঘিরে থাকে সর্ব ক্ষণ। তাই ফিরে যাই তাদের কাছে যারা আমাকে ব্যস্ত রাখে, সঙ্গ দেয়। তা ছাড়া আমি আর কোনও কাজ করি না বলে বাড়তি রোজগারও নেই। না লিখলে খাব কী? সেই সব কারণেই মন শক্ত করে নতুন উপন্যাসে হাত দেওয়া।

হয়তো ভাবছেন, লেখালিখিই যার পেশা, সে উপন্যাস লেখা ছেড়েই বা দিয়েছিল কেন! কারণ আছে। মনের ভিতর তীব্র আতঙ্কের জন্ম হয়েছিল। সে কথাতেই আসছি।

গত বছরে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম আমি, যেখানে একটা কারখানার কথা ছিল। সেই কারখানার এক গরিব শ্রমিকের ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা কাটা গিয়েছিল কোনও ধাতব পাত শাণিত করতে গিয়ে। কারখানার মালিকপক্ষ ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে তাকে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছিলেন।

উপন্যাসটা শেষ হওয়ার পর এক দিন আমাদের রাত-চৌকিদার এল তার ডান হাতে মোটা একটা ব্যান্ডেজ জড়িয়ে। আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে তোমার, ঝন্টু?”

সে বলল, “আমি দিনের বেলায় যে কারখানায় কাজ করি, সেখানে কাজ করতে করতে একটা মোটা লোহার রড পড়ে বুড়ো আঙুলটা থেঁতলে গিয়েছিল ক'দিন আগে।”

“তাই বুঝি ডিউটিতে আসোনি ক’দিন?” সহানুভূতি মাখানো গলায় খোঁচা দিই আমি।

“হ্যাঁ স্যর, আঙুলটা একেবারে পচে গিয়েছিল তো” মাথাটা নুইয়ে বলল ঝন্টু।

“তার পর?” অনুসন্ধিৎসু আমি।

“ডাক্তারবাবু ওটা কেটে বাদদিয়ে দিয়েছেন,” বিষাদমাখা গলায় বলল ঝন্টু।

একটু আগেই ওকে খোঁচা দিয়েছি ভেবে আমার খারাপ লাগে। বলি, “তবে তো তোমার কাজ করতে কষ্ট হবে এখন।”

“সে আমি ম্যানেজ করে নেব স্যর!” সন্তোষের সঙ্গে বলল ঝন্টু।

আমি আর একটু গভীরে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারি না। জিজ্ঞেস করি, “এই গ্রাউন্ডে কিছু ক্ষতিপূরণ দিলেন তোমার মালিক?”

“তা দিয়েছেন।” মাথাটা যথাসম্ভব হেলিয়ে বলল ঝন্টু।

আমি বলি, “তোমার মালিক খুব দয়ালু তো!”

“না না, সে সব কিছু না স্যর, ইউনিয়নের চাপে পড়ে দিতে হয়েছে,” সহজ গলায় বলল ঝন্টু।

অনধিকার চর্চা জেনেও আমি প্রশ্ন করে ফেলি, “কত পেলে?”

“এক লাখ স্যর!” মৃদু হাসি খেলে যায় ঝন্টুর ঠোঁটের কোণে।

“বাব্বাঃ, সে তো অনেক টাকা।” চোখ কপালে ওঠে আমার।

“দিতে তো হবেই। ডান হাতের বুড়ো আঙুল বলে কথা স্যর!” মুখের পেশিগুলো দৃঢ় হয়ে উঠেছে ঝন্টুর।

আমি চমকে উঠি। ভাবি, কথাগুলো কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে! ঝন্টু কি আমার লেখা ওই উপন্যাসটা পড়েছে?


ওই ঘটনাটাই ছিল শুরু। তার পর এই মাসখানেক আগে আমি আর একটা উপন্যাস শেষ করেছিলাম, যেটা এখন প্রকাশকের ঘরে মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে। দেশের বর্তমান অরাজকতা নিয়ে লেখা উপন্যাসটা। তার ভিতরে একটা ধর্ষণের স্পর্শকাতর ঘটনা ঢুকিয়ে দিয়েছি। কেননা আজকালকার পাঠকরা এমন উত্তেজক লেখা বেশ পছন্দ করেন। একটা বারো বছরের গরিব মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে, রেস্তরাঁয় খাইয়ে, সিনেমা দেখিয়ে, উপহার দিয়ে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক তাকে ধর্ষণ করেন দিনের পর দিন। তার পর যখন মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে তখন তাকে খুন করে বস্তায় পুরে নদীতে ভাসিয়ে দেন। কাজটা নিপুণ ভাবে করেছিলেন তিনি। ফলে প্রমাণের অভাবে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

লেখাটা প্রকাশককে জমা দেওয়ার দিনকতক পর থেকেই আমার কাজের মেয়ে পারুল কাজে এল না। পর পর তিন দিন কামাই করার পর আমি খোঁজখবর করতে শুরু করলাম। পারুলের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাকে যোগাযোগও করতে পারছি না। কাঁহাতক আর হোম ডেলিভারির খাবার খাওয়া যায়! তার উপরে আমি পেটরোগা মানুষ। বয়সও বাড়ছে। নিজে রান্নার ‘র’-ও জানি না। মা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তিনিই ও দিকটা সামলে নিতেন। এখন মনে হয় ঠিক বয়সে একটা বিয়ে করা উচিত ছিল। অল্প বয়সে নিজের লেখালিখি, লিটল ম্যাগাজ়িন ইত্যাদি নিয়েই সময় কাটিয়েছি। সময় কোথায় ছিল বিয়ে করার?

আমাদের দু’-তিনটে বাড়ি পরে ঝুমা নামের একটা মেয়ে কাজ করে, যে পারুলদের কলোনিতে থাকে। এক দিন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, “পারুলের খবর কিছু জানো? অসুখ-বিসুখে পড়েনি তো? এমন কামাই তো সে করে না!”

ঝুমা মাথা নিচু করে বলল, “পারুলের মেয়ে টুম্পাকে গত চার দিন হল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দাদা।”

“সে কী!” মনে মনে উৎকণ্ঠিত বোধ করি আমি।

“হ্যাঁ দাদা, সত্যি বলছি।” উদ্বেগ প্রকট হয়ে ওঠে ঝুমারও চোখে-মুখে।

আমি তড়িঘড়ি বলে উঠি, “পুলিশে খবর দিয়েছে?”

“হ্যাঁ দাদা।”

“কী বলছে তারা?”

“খোঁজখবর করছে।”

ওর সঙ্গে গতে বাঁধা কথোপকথন চলতে থাকে।

ঝুমার মুখখানা দেখে আমার কেন যেন মনে হল, আরও কিছু বলতে চায় সে। কিন্তু কুণ্ঠাবশত বলতে পারছে না। তাই বলি, “ঝুমা, আমার কিছু জানাশোনা মানুষ আছেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। বলো তো, আমিও খোঁজ করতে পারি।”

ঝুমার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। বলে, “একটু দেখুন না দাদা। বাপ-মরা মেয়েটাকে কত কষ্ট করে মানুষ করছিল পারুল।”

“ছিল বলছ কেন?” বিরক্ত হয়ে বলি আমি।

“মেয়েটা বোধহয় আর নেই...” ছলছলে চোখে বলল ঝুমা।

তার পর তার কাছ থেকে সব কথা শুনে তাজ্জব হয়ে যাই আমি। সরকারি প্রকল্পে একটা সাইকেল পেয়েছিল টুম্পা। সেই সাইকেল চালিয়েই স্কুলে যেত চোদ্দো বছর বয়সি মেয়েটা। স্কুল ছুটির পর একটা কম্পিউটার ক্লাসেও যেত ট্রেনিং নিতে। সেখানকারই কোনও টিচারের সঙ্গে প্রেম চলছিল তার। গত সপ্তাহে নাকি বমি করতে শুরু করেছিল মেয়েটা। ধরা পড়ে যাওয়ায় মায়ের কাছে মারও খেয়েছিল। তার পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঝুমারা সন্দেহ করছে, হয়তো কোনও হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে খালাস হতে গিয়ে মরে গেছে টুম্পা।

আমি বলি, “ওই ছেলেটা খুন-টুন করে ফেলেনি তো ওকে? তার পর হয়তো বস্তাবন্দি করে ভাগাড়ে ফেলে এসেছে বা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে!”

চমকে উঠে ঝুমা বলল, “আপনি কী করে জানলেন দাদা?”

আমি তুতলিয়ে জবাব দিই, “আন্দাজ করলাম আর কী। এ রকম কত খবরই তো পড়ি আজকাল খবরের কাগজে।”

পরদিন ঝুমা এল হাঁপাতে হাঁপাতে। বলল, “দাদা, আপনার আন্দাজই ঠিক। টুম্পার পচা-গলা শরীরটা বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া গেছে ভাগাড়ে। পুলিশ ওই ছেলেটাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে।” আমি সে কথা শুনে ধপাস করে বসে পড়ি সোফাটার উপরে। কপালে হাত দিয়ে বসে থাকি বহু ক্ষণ।

ঝুমা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “মন খারাপ করবেন না দাদা, শান্ত হোন। আমাদের সকলেরই মনের অবস্থা এক। পারুলের কথা একটু ভেবে দেখুন তো, কী নিয়ে থাকবে এখন ও?”

কিন্তু আমি তাকে বোঝাই কী করে যে, আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ সব কিছুই ঘটত না, যদি আমি ওই উপন্যাসের ঘটনাটা না লিখতাম। যে কোনও মানুষ শুনলেই বলবেন যে এ এক সমাপতন, এ নিয়ে নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনও অর্থই হয় না। কিন্তু ঝন্টুর ঘটনাটা তবে কী? সেটাও কি সমাপতনই ছিল? কী করে হয় এমন?


দীর্ঘ সময় আর কিছুই লিখিনি। কিন্তু সময় সব ঘটনার অভিঘাতই ফিকে করে দেয়। প্রকাশকের কথাতেই যথেষ্ট ইন্ধন ছিল। তাই কপাল ঠুকে ফের শুরু করেছি আর একটা উপন্যাস। মোটামুটি মাসদেড়েক আগে। এই উপন্যাস লেখার কথাটা বলেই গল্পটা শুরু করেছিলাম।

এ বার আসি নতুন উপন্যাসটার কথায়। এটা একটা প্রেমের গল্প। একটা বিমান সংস্থার কেবিন ক্রু ছেলেটি। দারুণ স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম। মেয়েটিও করিতকর্মা। একটা ইউনিসেক্স পার্লার চালায় সে। সেই পার্লারেই পরিচয় তাদের। প্রথম দশটা পর্বে প্রেমটা বেশ জমে উঠেছে। শারীরিক মিলনও হয়েছে দু’বার। বাড়ির লোকেরা বিয়ের জন্যচাপ দিচ্ছেন।

এতটা লিখে ফেলার পর মনে হল বড়ই সরলরৈখিক হয়ে যাচ্ছে গল্পটা, একটু চমক বা মোচড় না থাকলে পাঠকদের পছন্দ হবে না। একটু রহস্য, একটু রোমাঞ্চ না থাকলে তারা পয়সা খরচ করে কিনবে কেন বইটা? এমনিতেই আজকাল এত বিনোদন আকাশে-বাতাসে। তাই দিলাম ছেলেটার বিমান সংস্থাকে দেউলিয়া করে। কোভিড-পরবর্তী সময়ে যেটা খুবই মানানসই। সত্যি সত্যিই কত সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, কত মানুষ চাকরি হারিয়েছে পৃথিবী জুড়ে। তাই এ ছেলেটাও তার চাকরি হারাক।

করোনাকালে মানুষজন এ দেশ থেকে সে দেশে যেতে পারেনি বলে বিমান-চলাচল হয়নি। ফলে বহু বিমান সংস্থারই নাভিশ্বাস উঠছে। তাই যারা চাকরি হারাচ্ছে, তাদের পক্ষে নতুন চাকরি পাওয়া অসম্ভব। এ ছেলেটাও কোথাও চাকরি পেল না। আর বেকার ছেলেকে কোন মেয়ে পছন্দ করবে? মেয়ের বাবা-মাও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ফলে ছেলেটা মানসিক অবসাদের শিকার হল। আর সেই অবসাদ সহ্য করতে না পেরে তারই অ্যাপার্টমেন্টের তেরো তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

বেশ জব্বর মোচড় আনতে পেরেছি উপন্যাসে ভেবে পিঠ টানটান করলাম। হঠাৎ কানে এল ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ।

ধুপ করে একটা আওয়াজ হল না! না কি আমার নিজেরই মনের ভুল? আসলে একটা গল্প বা উপন্যাস লিখতে লিখতে তার ভিতরেই ঢুকে পড়ি আমি। সেখানকার চরিত্র বা ঘটনাগুলোকে সত্যি ভেবে বসি।

কিন্তু আমাদের সিঁড়ি দিয়ে এত লোক ওঠানামা করছে কেন হঠাৎ? আমি ঝন্টুকে ফোন করলাম। কিন্তু ওর ফোনটা বেজে গেল। লেখা থামিয়ে, ল্যাপটপটা শাটডাউন করে, চপ্পলজোড়া পায়ে গলিয়ে আমার অ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা খুললাম। আরও অনেকের সঙ্গে দেখলাম ঝন্টুও নেমে আসছে ছাদ থেকে।

ওকে ডেকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপারটা কী? ফোন তুলছ না কেন? এত লোকই বা কোথা এল এত রাতে?”

ঝন্টু বলল, “আপনি কোনও আওয়াজ শোনেননি স্যর?”

“হ্যাঁ, শুনেছি। কোথাও একটা ভারী কিছু পড়ল মনে হল যেন।” বললাম আমি।

ঝন্টু বলল, “ঠিকই শুনেছেন স্যর। পাশের বাড়ির ছেলেটা উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করতে পারেনি। ওদের বাড়িটা তো দোতলা, তাই এ বাড়ির সাত তলার ছাদে উঠে ঝাঁপ দিয়েছে। পুলিশ এসেছে নীচে।”

আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। কোনও রকমে দেওয়াল ধরে সামলে নিলাম নিজেকে। নীচে যাওয়ার সাহস নেই আমার। টলতে টলতে ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ থেকে ডিলিট করে দিলাম আমার অর্ধেক লেখা উপন্যাসটার ওয়ার্ড ফাইল।

এ জীবনে হয়তো আর উপন্যাস লেখার সাহস হবে না আমার।