দুই জনে উদ্যানমধ্যে লতামণ্ডপতলে দাঁড়াইয়া ছিলেন।’’
উক্ত দুইজনের পরিচয় বিধৃত করিবার পূর্বে স্থানটির সহিত স্বল্প পরিমাণ জ্ঞাত হইলে, বৃক্ষদ্বারা অধ্যুষিত, জলদ্বারা বেষ্টিত, দ্বীপদ্বারা শোভিত অঙ্গনটির মাহাত্ম্য বুঝা যাইবে। পৃথিবীর বহু স্থানে অবহেলিত হইয়া সুন্দর পড়িয়া থাকে। মনুষ্য সুন্দরকে আবিষ্কার করিতে পারে না। যেমন কলিকাতার দক্ষিণে অবস্থিত রবীন্দ্রসরোবর নামক একটি জলাশয় লইয়া যে-রূপ আভিজাত্যমণ্ডিত, গর্বসঞ্চারিত বক্ষদেশ দেখাইয়া দক্ষিণস্থিত মনুষ্যবর্গ তৃপ্তি লাভ করে, তাহার এক শতাংশও পূর্ব কলিকাতায় অবস্থিত সুভাষসরোবর সম্পর্কে হয় কি না, তাহা বলিতে পারি না। কেহ কেহ জানেন, ব্রাত্য বেলিয়াঘাটায় একটি দীর্ঘকায় জলাভূমি আছে। এই জলাশয় নেতাজির নাম ধারণ করিয়া ‘সুভাষসরোবর’ হইলেও অদ্যপি জাতে উঠিতে পারে নাই। অথচ ইহার শোভা অশেষ। যাহার দেখিবার দৃষ্টি আছে, অনুভব করিবার হৃদয় আছে, সে একবার এই স্থানে আসিলেই অবগত হইবে, কত কাল ধরিয়া সুন্দর এইখানে অপেক্ষা করিয়া আছে! উদ্যানস্থিত বৃক্ষসমূহ, জলরাশির সবুজাভ মুক্তার ন্যায় মধ্যস্থলে অবস্থিত দ্বীপটিতে উড়ন্ত, চঞ্চল, স্থির, কূজন-স্বভাব নানা বর্ণের পক্ষী, উচ্চ-অনুচ্চ তরুরাজি, লতাগুল্মের অনির্বার আধিক্য ও চতুষ্পার্শ্বের পথ— আগন্তুককে মোহে বাঁধিয়া ফেলিবে়, মুগ্ধতায় অবশ করিবে।
এমন প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ, জলাশয়ে অবস্থিত, মাধবীলতায় আচ্ছাদিত একটি মণ্ডপে দাঁড়াইয়া যাহারা কথা বলিতেছে, তাহারা পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত। পরস্পরের প্রতি এই তরুণ-তরুণী প্রণয়াসক্ত। তবে গত তিন-চারি মাস ধরিয়া ইহারা বুঝিতে পারিতেছে, প্রেম জীবনপ্রতিমা নির্মাণ করিতে পারে না। বরং অতুল শক্তিধর জীবন প্রেমের প্রতিমা গড়িতে পারে, তাহাকে পূজার সিংহাসনে বসাইতে পারে, সসম্মানে বরণ করিতে পারে। আবার কাল বিলম্ব না-করিয়া অতলান্তে তাহা বিসর্জন সম্পন্ন করিতে জীবনের কোনও বেদনাবোধ হয় না। যুবকটির নাম পুরন্দর। বিহার হইতে চারপুরুষ পূর্বে বাংলায় আসিয়া এক্ষণে তাহার পরিবার বাঙালি হইয়া গিয়াছে। তরুণীটি প্রতিবেশীদের নিকট হিরণ বলিয়া পরিচিত। পুরা নাম হিরণ্ময়ী। ইহার পরিবার পূর্ববঙ্গ হইতে আগত উদ্বাস্তু।
পুরন্দর ও হিরণ্ময়ীর যে-মিলটি সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয়— তাহা হইল দারিদ্র। হিরণ্ময়ীর পিতা সাইকেল-রিকশা চালক দয়াল। তাঁহার আরও একটি কন্যা আছে। প্রথম সন্তান একটি পুত্রও তাঁহার ছিল। কিন্তু সে জীবনের নির্মোহ অবস্থানের সহিত মানাইতে না-পারিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে। স্থানীয় মানুষ অবশ্য বলে, অত্যধিক নেশাগ্রস্ত হইয়া সে আর উঠিয়া দাঁড়াইতে পারে নাই। পাষাণী পৃথিবী তাহার মস্তিষ্ক চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া ইতি টানিয়া দিয়াছে। দুই কন্যার মাতা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদিগের গৃহে পরিচারিকার কর্ম করিয়া অর্থ উপার্জনের আপ্রাণ চেষ্টায় নিরত। মাধ্যমিক পাশ হিরণ্ময়ী সূচিকর্মনিপুণা। মহিলাদের গাত্রবস্ত্র নির্মাণ ও শাড়িতে মেকি পাড় বসাইবার কর্মে নিয়োজিত। উহার ভগিনী বিন্দুময়ী বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পাঠ লইতেছে।
পুরন্দর সাধারণ স্তরে বিএ পাশ দিয়া যথারীতি কর্মহীন জীবনযাপন করিতেছে। তাহার পিতা সুরেন্দর নারিকেলডাঙ্গার প্রধান রাস্তায় অবস্থিত একটি জুট মিলে শ্রম দিয়া পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করিত। কিন্তু নালিতা উদ্ভিজ্জ পট্ট বা পাটের দিন ফুরাইয়াছে। ফলত, উৎপাদন ও প্রয়োজনের মধ্যবর্তী স্থানটি বৃহদাকার ধারণ করিবার কারণে মিল বন্ধ হইয়া গিয়াছে। সুরেন্দর এক্ষণে এক গৃহনির্মাতা সংস্থার অধীনে শ্রমিকবৃত্তি গ্রহণ করিয়াছে। বলিতে গেলে, শ্রমিক হইতে শ্রমিকই রহিয়াছে— কেবল তাহার পরিচয় বদল হইয়াছে। ইহাদের উপাধি সিংহ। হিরণ্ময়ীদের দেবনাথ। প্রেম আসিয়া যখন ফুল্লকুসুমিত দ্রুমদলশোভিনী কল্পোদ্যান নির্মাণ করে, ভালবাসার বারিবর্ষণে ভাসাইয়া লইয়া যায়, তখন জাতপাত কিংবা উপাধি অবান্তর বোধ হয়। জীবননদী মোহনার দিকে ধাবিত হইতে চায়, উৎসের দিকে নহে।
পুরন্দরের দুই দিদির বিবাহ হইয়া গিয়াছে। দণ্ডবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া সুরেন্দর দুই কন্যাকে অষ্টাদশ বৎসরের পূর্বেই বৈতরণী পার করিয়া দিয়াছে। কর্মহীন পুত্রকে লইয়া সে সবিশেষ চিন্তিত। তাহার উপর দয়ালের প্রথম কন্যাটির সহিত আপন পুত্রের ফস্টিনস্টি সম্পর্কে এই লোকালয়ের সকলেই অবগত। যথারীতি দয়াল কর্মহীন, আয়শূন্য পুরন্দরকে পছন্দ করে না। সুরেন্দরদের টালির বাড়ির সন্নিহিত রাস্তার টাইম কলে স্নান সারিতে আসিয়া সুরেন্দর একদিন লোকমুখে শুনিয়াছিল, হিরণের সহিত বিবাহ দিবার নিমিত্ত দয়াল সুউপায়ী কোনও পাত্রের সন্ধান করিতেছে। অপদার্থ পুরন্দরকে সে নেশাখোর বলিয়া চিহ্নিত করিতেও ছাড়ে নাই। এইসব শুনিয়া সুরেন্দরের মস্তকে ক্রোধের আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। সে ভাবিয়াছিল, রিকশা হইতে দয়ালকে মাটিতে ফেলিয়া জিজ্ঞাসা করিবে, ‘‘তুই কি মনে করিস গরিব শুধু জল খেয়ে শুদ্ধ হয়ে থাকবে? আর বড়লোক মদ খেয়ে পবিত্তর হবে? শালা, তোমায় মেরে ছবি বানিয়ে দেব।’’
অনুরাগাক্রান্ত একমাত্র পুত্রের মুখ চাহিয়া সে চুপ করিয়া গিয়াছে। বরং দয়াল যে-আগুন জ্বালাইয়াছে, তাহাতে তাহারই ঘর পুড়িতেছে, সুরেন্দরের কিছুই হয় নাই। কেননা, পুরন্দর বিনা আর কাহাকেও সে বিবাহ করিবে না। জুট মিলের ফটকে লক আউট ঘোষণার নিমিত্ত লুটিশ টাঙাইয়া দিবার মতো, বাড়িতে হিরণ একাধিকবার মৌখিক লুটিশ দিয়াছে। কন্যাটি যে ইস্পাতের ন্যায়, দয়াল তাহা জানে। তবু সে পুরন্দরের নিন্দা করিতেছে! হিরণকে পুত্রবধূ রূপে গ্রহণ করিতে সুরেন্দরের কোনও আপত্তি নাই। এক দরিদ্রের ঘর হইতে শ্রী আসিয়া আর এক দরিদ্রের ঘর হয়তো আলো করিবে। ইহার বেশি আর কী ঘটিবে! একখণ্ড সোনা মেয়েটি হয়তো আনিলেও আনিতে পারে। দয়ালের সামর্থ্য সুরেন্দরের অজানা নাই। হিরণকে লইয়া সে যতই গর্ব প্রকাশ করুক না কেন, পুরন্দর সম্পর্কে তাহার আপত্তির কারণ ধোপে টিকিবে না। তাহার পুত্র বসিয়া নাই। চেষ্টা করিতেছে। বেকারের তকমা আজি-কালির মধ্যে মুছিয়া ফেলিবে।
মৃদু-মন্দ বাতাস জলের উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে। সন্ধ্যা নামিবার আয়োজন সম্পূর্ণ হইবার পূর্বেই, চন্দ্রালোকের আভা সরোবর-সংলগ্ন উদ্যানে যেন নামিয়া আসিল। সরোবরের জলে তরঙ্গ নাই, কিন্তু বাতাসের স্পর্শে কুঞ্চন সৃষ্টি হইতেছে। ক্ষুদ্রাকৃতি একটি ইষ্টকখণ্ড জলে ছুড়িয়া দিয়া পুরন্দর ম্লান হাস্যে বলিল, ‘‘শুনছি তো তোমার বাবা নাকি খালপাড়ে একটা ছেলের সন্ধান পেয়েছে। গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে। সব ঠিকঠাক চললে, আসছে শীতে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে।’’
ওষ্ঠাধর স্ফীত করিয়া হিরণ বলিল, ‘‘তোমার মুখে এ ছাড়া কি আর কোনও কথা নেই? বিয়ে তো আমি করব, বাবা তো করবে না!’’
শুষ্ক স্বরে পুরন্দর কহিল, ‘‘মানুষের মন ঘড়ির কাঁটার মতো ঘোরে। জানি, তুমি আমাকে ছাড়া আর কারও সঙ্গে ঘর বাঁধবে না। তবে কী জানো, ওই ঘড়িটা যে-কোনও সময়ে বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে।’’
‘‘তোমাকে কিন্তু এবার একটা কাজকর্ম দেখতেই হবে। জানো, আমি প্রায় স্বপ্ন দেখি, তুমি খুব ভাল একটা কাজ পেয়েছ। হাজার পাঁচেক টাকা মাইনে। এছাড়া উপরিও আছে। ...অনেক কষ্টে আছি, কিন্তু মরিনি। বেঁচে আছি। আর তুমি আমায় খুব ভালবাসছ,’’ হিরণের কণ্ঠ হইতে যেন অমৃত ঝরিয়া পড়িল।
অসহায় গলায় পুরন্দর বলিল, ‘‘কোথাও কোনও কাজ নেই গো! লেবার হতে পারলে পয়সা আছে। এক-এক সময় মনে হয়, বিএ পড়ে কেন সময় নষ্ট করলাম। আমার বন্ধু দজু ইস্কুলে পড়ার সময় ইলেকট্রিকের কাজ শিখতে শুরু করেছিল। এখন পুজো প্যান্ডেলে, বিয়েবাড়িতে লাইট দেয়। ভাল ব্যবসা ফেঁদেছে। পয়সা তো করেইছে, শুনলাম ট্যাংরায় তিন কাঠা জমি কিনেছে, বাড়ি করবে।’’
‘‘দজু তোমাকে ম্যানেজারের কাজ দিতে পারে না?’’ হিরণের স্বর আকুল শুনাইল।
স্বল্পক্ষণ চুপ থাকিয়া পুরন্দর বলিল, ‘‘নাইনে ফেল করে দজু ইস্কুল ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ওর সামনে গিয়ে কী করে দাঁড়াব, হিরণ? আমার সম্মান বলে কি কিছু নেই? দজু আর আমি এক!’’
অকস্মাৎ হিরণ রাগিয়া গেল, ‘‘সম্মান ধুয়ে জল খেলে কি তোমার পেট ভরবে, নাকি আমার ভরবে! বলো, বলো! আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই চিনি না। তোমাকে সর্বস্ব দিয়েছি। শরীরের কোনও জায়গা বাকি নেই, যা তুমি পাওনি। শুনছ, ওগো, আমি তোমাকে ছাড়া আর কারও সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব না।’’
আপন মর্মে পুরন্দর বিলক্ষণ অবগত আছে, হিরণ প্রেম লইয়া খেলিতে নামে নাই। ভালবাসাকে এই যুবতীটি সন্দেহপ্রবণতা ও অবিশ্বাস হইতে দূরে রাখিয়াছে। পুরন্দরের প্রতি তাহার বিশ্বাস এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, এক একসময় পুরন্দর কাঁপিয়া ওঠে। হিরণকে কাটাইয়া দিতে পারিলে সে এই বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারিত। কিন্তু কোনওরূপ ভরসাস্থল সম্মুখে না-দেখিয়াও, হিরণ তাহার নিকট আত্মসমর্পণ করিতে সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুত। এই স্থানটিতে পুরন্দর পরাজিত হইয়া বসিয়া আছে। নীড়ে ফিরিয়া আসিয়াছে অগণন প্রজাতির পক্ষীসকল। তাহাদের কাকলি এখনও পুরাপুরি বন্ধ হয় নাই। অস্তাচলে সূর্য ডুবিয়া যাইবা মাত্র ইহারা কী করিয়া উড়ন্ত ডানা নিঃশব্দে গুটাইয়া লয়, তাহা ভাবিয়া পুরন্দর মাঝেমধ্যে অবাক হইয়া যায়। পুরন্দরের মোবাইল বাজিয়া উঠিল। ‘‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যাঁ চিন্ময়দা বলুন।’’
‘‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। নিশ্চয়ই যাব। যা করতে হবে বলবেন। আমাকে আলাদা ভাববেন না দাদা।’’
‘‘তাতে কী হয়েছে! আমার মতো কলেজ পাশেরা মড়া পোড়ানোর চাকরিও পাচ্ছে না। ...তবে যা হোক একটা কাজ না-পেলে জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে... হ্যাঁ, হ্যাঁ যাব।’’
যদিও আলাপ নাই, তথাপি চিন্ময়দাকে হিরণ চেনে। ভদ্রলোকের বাড়ি ওদের পাশের পাড়ায়। একটি বড় ছাপাখানা আছে জোড়ামন্দির অঞ্চলে। পুরন্দরকে নিশ্চয়ই আসন্ন বিশ্বকর্মা পূজায় তিনি নিমন্ত্রণ করিলেন। যেন শৈশবে ফিরিয়া গেল, এমনভাবে হিরণ বলিল, ‘‘শোনো, শোনো তোমাকে যে-টি-শার্টটা দিয়েছি, সেটা পুজোর দিন পরবে। কেমন! আমার খুব ভাল লাগবে।’
মস্তক আন্দোলিত করিয়া পুরন্দর সম্মতি জানাইল। চলমান বৎসরে তাহার জন্মদিনে হিরণ মার্কিনি স্টাইলের জামাটি সস্তা দরে কিনিয়া তাহাকে উপহার দিয়াছে। টি-শার্টটির পশ্চাতে ইংরাজিতে একটি বাণী উদ্ধৃত আছে। সরোবর সজ্জিত করিবার নিমিত্ত ত্রিফলা, দ্বিফলা, অধোমুখী, ঊর্ধ্বমুখী সাদা আলোসকল একযোগে জ্বলিয়া উঠিল। হিরণ সালোয়ার-কামিজ ঠিক করিয়া লইল। রাত যত ঘন হইতে থাকিবে, ততই সরোবরটি বিভিন্ন নেশাগ্রস্তের হস্তে চলিয়া যাইবে। হঠাৎ পুরন্দর পাতলুনের পকেট হইতে কাগজের একখানি ক্ষুদ্র মোড়ক বাহির করিয়া খুলিয়া ফেলিল। উন্মুক্ত কাগজের উপরে হরিৎ বর্ণের উপবৃত্তাকার প্রস্তর টুকরা খোদিত, রৌপ্যসদৃশ কোনও ধাতু দ্বারা নির্মিত দুইটি অঙ্গুরীয় শোভা পাইতেছে। হিরণ অঙ্গুরীয়দ্বয় স্পর্শ করিতে গিয়াও হাত সরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘‘আংটি? কার? আংটি কী হবে?’’
‘‘তোমাকে বলিনি, গত মাসে রানিগঞ্জের এক জায়গায় চাকরি পাওয়ার আশায় একদিনের জন্যে গেছিলাম। একটা রেফারেন্স ছিল। শোনো, ধর্মশালার কেয়ারটেকারের কাজ। মাইনে দেবে বলল দশ হাজার টাকা। কিন্তু যা করতে হবে মালিকের মুখে শুনলাম, তা এককথায় হ্যাপার একশেষ! যা কিছু চুরি হবে, কেউ হাতিয়ে নেবে, তার দায় আমার। সে সবের দাম আমার মাইনে থেকে কেটে নেবে। চাকরির নামে ফাঁদ। দূর, দূর, চলে এলাম।’’
‘‘চলে এলে কেন? কয়েকদিন, মানে মাসখানেক করতে পারতে। এত ভিতু হলে আর আগে থেকে খারাপটা ভেবে নিলে কিছু করতে পারবে ভেবেছ?’’ হিরণ খুশি হইল না, রুক্ষ স্বরে বলিল।
মাথা নিচু করিয়া পুরন্দর উত্তর দিল, ‘‘বিশ্বাস করো, ফেঁসে যেতাম। চলে আসার সময় তোমার মুখ মনে পড়ছিল।’’
‘‘বাজে কথা বলার তুমি মাস্টার। ...কতদিন আমাকে আদর করনি।’’ হিরণ কপট রাগ দেখাইয়া পুরন্দরের বক্ষদেশের নিকটে আসিয়া চন্দ্রবদনখানি তুলিয়া ধরিল। চতুর্দিক অপলকে অবলোকন করিয়া পুরন্দর প্রেমসোহাগিনীর অধরে চুম্বন করিল। তবে দীর্ঘক্ষণ ধরিয়া নহে। মৎস্যরঙ্গ পক্ষী যেরূপে জল হইতে মৎস ছোঁ মারিয়া তুলিয়া লয়, সেইরূপে চুম্বন সমাপ্ত করিয়া, পুরন্দর খুশি খুশি হইয়া বলিল, ‘‘আমি যেদিন ধর্মশালায় রাতে ছিলাম, সেদিন ওখানে এক সাধুবাবাও ছিলেন। জানো, তিনি মাত্র দশটাকায় এই দুটো আংটি দিয়ে বললেন, তুমি যাকে বিয়ে করবে ঠিক করেছ, বিয়ের আগে তার সঙ্গে এই আংটি বদল করে নিয়ো। মঙ্গল হবে বাবা, মঙ্গল হবে।’’ সন্ন্যাসী মানুষটি হিরণের ইঙ্গিত করিল দেখিয়া পুরন্দর সেদিন অবাক হইয়াছিল।
হিরণ বিস্মিত হইয়া অঙ্গুরীয়দ্বয়ের দিকে চাহিয়া রহিল। পুরন্দর ঢোক গিলিয়া অনুনয় করিল, ‘‘শোনো না, এসো না, সাধুর কথা মেনে দু’জনে দু’জনকে আংটি পরিয়ে দিই।’
মুগ্ধ বিস্ময়ে হিরণের কথা বাহির হইতেছে না। পুরন্দরের প্রেমকে সে প্রত্যয়ী মনোভাবসহ গ্রহণ করিয়াছে। ইহা তাহার কাছে ভ্রান্তি নহে। এই যুবকটির জন্য সে মরিতেও প্রস্তুত। প্রেমের সাফল্য সম্পর্কে সে একপ্রকার নিশ্চিত। বড় অঙ্গুরীয়টি পুরন্দরের মধ্যমায় সে পরাইয়া দিল। আনন্দে হাসিল, কাঁদিল, অঙ্গুলি দিয়া অশ্রু মুছিল। পুরন্দর ক্ষুদ্রাকৃতি অঙ্গুরীয়টি হিরণের অনামিকায় সামান্য চাপ দিয়া প্রবেশ করাইতেই হিরণ বলিল, ‘‘এই যে মশাই, আজ এই মুহূর্তে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। তুমি কিন্তু আর অস্বীকার করতে পারবে না। বাবাকে আংটিটা দেখিয়ে সব বলে দেব। বাড়ি থেকে বের করে দিলে দেবে— তুমি তো আছ!’’
আশ্রয়কাঙ্ক্ষিনীর ন্যায় হিরণ সব ভুলিয়া পুরন্দরকে জড়াইয়া ধরিল।
হরিৎ প্রস্তর (আদতে কাচ) সংযুক্ত অঙ্গুরীয়-বিনিময়ের গল্প দুই তিনদিন পরেই লোকালয়ে চাউর হইয়া গিয়াছে। বসতির অধিবাসীরা কেহ হাসিল, কেহ নিন্দা করিল, কেহ উন্মাদপ্রায় পাত্র-পাত্রীর কপাল দগ্ধ হইবার শঙ্কায় শিহরিত হইল, কেহ বা ভাবিল ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’। আশ্চর্যের ব্যাপার হইল, দয়াল আগামী অগ্রহায়ণে পুরন্দরের সহিত হিরণ্ময়ীর বিবাহ সম্পর্কিত কথাবার্তা সুরেন্দরের সহিত পাকা করিয়া লইল।
সব হইল, কিন্তু পুরন্দর অর্থোপার্জনের পথ খুঁজিয়া পাইল না। শিউলিফুলের মালা পরিয়া শরৎ বিদায় লইল। দুর্গোৎসব উপলক্ষে প্রভূত অর্থ বাষ্পীভূত হইবার পর, প্রকৃতি দেবী হেমন্তের বিষণ্ণ আসনখানি বিছাইয়া দিলেন। ইত্যবসরে মরিয়ার ন্যায় পুরন্দর বিশ্বকর্মা পূজায় প্রভূত শ্রমদান করিয়াছে বলিয়া প্রেসের মালিকটি তাহার উপর আপাতত প্রীত। পুরন্দর তাঁহাকে হিরণ্ময়ীর সহিত জীবন অতিবাহিত করিবার সংকল্প বলিয়াছে। সব শুনিয়া তিনি অর্থহীন হাসিয়া বলিয়াছেন, ‘‘পৃথিবী জুড়ে কাজ আছে, কিন্তু চাকরি নেই। ঠিক আছে, তুমি যখন আতান্তরে পড়েছ, তখন দেখি কিছু করা যায় কি না!’’
বিসর্জিত, ডুবন্ত, দয়াভিক্ষুক পুরন্দর পূজার ভাসানের দিন দুপুরে ফোন করিয়া হিরণকে জানাইল, ‘‘চিন্ময়দা আমাকে একটা কাজ দিয়েছে, তবে চাকরি নয়। নো ওয়ার্ক নো পে। চিন্ময়দার পার্টিদের কাছ থেকে অর্ডার আর পেমেন্ট কালেক্ট করতে হবে। দিনে তিনশো টাকা দেবেন। দূর শালা, ভাল্লাগে না!’’
হিরণ চুপ করিয়া রহিল। কত হাজার টাকা দিয়া জীবনকে মাপিতে পারা যায়, হিরণ তাহা জানে না। সহস্র, লক্ষ, কোটি ইত্যাদি শব্দগুলি কি আদতে ক্রীড়াকৌতূক? পুরন্দর পুনরায় বলিল, ‘‘লেকে ঠাকুর ফেলতে যাব। আজ তোমার দেওয়া জামাটা পরেছি।’’
ভ্যান-রিকশায় বিশ্বকর্মাদেব হেলিয়া-দুলিয়া চলিতেছেন। সামনে চিন্ময়বাবুর কর্মিগণ দু’-তিন পাত্র দেশি চড়াইয়া ধুনুচি নাচ নাচিতেছেন। তাঁহাদের সহিত পুরন্দরও যোগ দিয়াছে। অন্য আর-একটি ভাসানের সার্চ লাইট পুরন্দরের পৃষ্ঠদেশে একঝলক পড়িয়া আলো-আঁধারিতে মিলাইয়া গেল। চিন্ময়বাবু সেই সময় স্পষ্ট দেখিলেন, পুরন্দরের ঘামে ভেজা জামাটির পশ্চাতে সাদা রঙে কায়দা করিয়া লিখা আছে: ‘Kill me tomorrow, let me live tonight’।
নেশাগ্রস্ত পুরন্দর নাচিতে-নাচিতে হঠাৎ চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘‘বিশ্বকর্মা মাইকি জয়!’’
পুনর্নির্মাণ: যুগলাঙ্গুরীয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়