চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ নিয়ে বসে ছিল বিভাস। আকাশটা কালো হয়ে আছে। বৃষ্টিটা ভাল করে আসার আগে অফিস পৌঁছতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। মনে হচ্ছে ভিজতে হবে।
দমকা হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকল কঙ্কা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখে বিরক্তির ছাপ। বলল, “আর ভাল লাগছে না। কবে দেবে বলো তো ফ্ল্যাটটা? দিনের পর দিন...’’
‘‘আবার কী হল সাতসকালে?” বিভাসের গলায় কৌতূহল। বুঝল বরাবরের মতো কঙ্কার প্ল্যান এ বারও মাটি। তাই উত্তেজনার পারদ চড়ছে।
গজগজ করে কঙ্কা বলল, “আজ বেরনো যাবে না। দিদি নেমন্তন্ন করে ফেলেছে। দাদা বাজারে বেরিয়ে গেলেন। আমাকে আগে থেকে এক বার জানায়ওনি!”
ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগল না। কঙ্কার বাড়াভাতে ছাই পড়েছে। কালকেই শুনেছিল বিভাস। বৌদির পিসতুতো ভাই সমরেশদা বিদেশ থেকে এসেছেন। তাঁকে এক দিন নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো প্রয়োজন। দাদা-বৌদি নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করছিল। কঙ্কার সঙ্গে আলোচনার কোনও পাটই নেই। বৌদি হাই প্রেশারের রোগী। রান্নাবান্না এড়িয়ে যায়। কঙ্কা রান্না করতে ভালবাসে। খুশি মনে সব সামলায়। কিন্তু সে হয়ে গিয়েছে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’। ফলে মাঝে-মাঝেই কঙ্কার মাথা গরম হয়। কিন্তু গর্জন, বর্ষণটা নিজেদের ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কিন্তু আর নয়। বিভাসেরও ব্যাপারটা আর খুব একটা ভাল লাগছে না। তাই দেখেশুনে একটা ফ্ল্যাট বুক করেই ফেলেছে সে। কঙ্কা খুব খুশি। নিজের মতো করে গুছিয়ে সংসার করার সাধ তো তারও আছে। তা ছাড়া একটা ঘরে আর চলে না। টুপসি বড় হচ্ছে। তবে মুখ ফুটে চলে যাওয়ার কথা দাদাকে কবে বলে উঠতে পারবে কে জানে! এখানেই বার বার আটকে যাচ্ছে বিভাস।
আজ একটু বেরোবে ভেবেছিল কঙ্কা। অনেক দিন মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া হয় না। সংসারের ঘানি তো ঘুরেই চলেছে। মেয়েটার সামনে জন্মদিন। একটু কেনাকাটা করে, বাইরে খেয়ে ফেরা... এইটুকুই। জা-কে বলে রেখেছিল কঙ্কা। মনে রাখেনি বা পাত্তা দেয়নি, বোঝাই যাচ্ছে।
কঙ্কার মধ্যে সব সময় সবাইকে খুশি রাখার একটা তাগিদ কাজ করে। যত চোটপাট নিজেদের ঘরে, বিভাসের সামনে। তবে এ বার সে নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য খেপে উঠেছে। নিজের ইচ্ছে, শখ, আহ্লাদ নিয়ে বেঁচে থাকতে কার না ইচ্ছে হয়! বিভাসেরও আর ভাল লাগছে না। তা ছাড়া টুপসির কথাটাও তো ভাবতে হবে। লেখাপড়ার চাপ বাড়ছে। একটু আলাদা জায়গা দরকার।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল বিভাস। বিকেলের প্রোগ্রামের কথা আলোচনা করে আর লাভ নেই। অলরেডি অন্য প্রোগ্রাম ঠিক হয়ে গিয়েছে। তোয়ালেটা হাতে নিয়ে স্নানে যাওয়ার আগে কঙ্কাকে আশ্বস্ত করল, “আজই খোঁজ নিচ্ছি। কাজ তো প্রায় শেষ। শিগ্গিরই হ্যান্ড ওভার করবে। কবে শিফ্ট করা যায় দেখছি। আর শোনো, বিকেলে আমরা বেরোব। বৌদি যা পারে করুক।’’
কঙ্কা একটু দম নিল। বিভাস এ রকম প্রায়ই বলে। আজ বেরোনো কোনও মতেই সম্ভব নয়। টুপসিকে বোঝাতে হবে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরোল কঙ্কা।
বড়জা বিপাশা সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। কঙ্কাকে দেখে দাঁড়ালেন। বললেন, “চিংড়ি আনতে বললাম, বুঝলি! খেজুর আমসত্ত্বও বলেছি। এখন দেখ তোর দাদা কী করে।’’
বেজার মুখে ঘাড় নাড়ল কঙ্কা।
“আর পারি না রে। সকালের ওষুধটাও খাওয়া হয়নি।’’
বিপাশার কাঁচাপাকা চুল, চওড়া পাড় তাঁত, ভারী শরীরে ক্লান্তির ছাপ। একটু দেরি করে ওঠেন বলে ভোরের চা-টা ঘরেই দিয়ে আসতে হয়। কঙ্কার মুখচোখ তিনি খেয়াল করলেন না।
“যাও ঘরে গিয়ে ওষুধটা খেয়ে নাও। আমি এ দিকটা দেখছি,’’ কাজে ডুবে যায় কঙ্কা।
সকালের রান্না শেষ করে ফেলতে না পারলে ওবেলার আয়োজনে হাত লাগানো যাবে না। বিভাসের বিশেষ কিছু চাহিদা নেই। না। মাছের ঝোলটা হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত। ভাশুর একটু সাজিয়ে খেতে ভালবাসেন। ডালের সঙ্গে দু’-একটা ভাজা, নিরামিষ তরকারি করতেই হয়। বিভাস বেরিয়ে গেলে ধীরেসুস্থে করা যাবে। এক ফাঁকে নারকোলটা কুরে নিতে হবে। যদি চিংড়ি আসে।
সকালের জলখাবার মুখে তোলার সময় হয়নি আজ। ভাশুরপো অভ্র বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেল। বলে রেখেছিল, “একটু চাউমিন করে দেবে কাম্মা? আমরা চার জন আছি।’’
সে সব করে জলখাবারের পাট মেটাতে মেটাতে বেলা গড়িয়ে এল। টুপসির কথা ভেবে একটা নিঃশ্বাস চেপে কাজ সারতে লাগল কঙ্কা। ওদের ঘরটা জিনিসপত্রে ঠাসা। ওর পড়ার ছোট্ট টেবিলটা কোনও রকমে ঢোকানো হয়েছে। মেয়েটার গানের গলা ভাল। গান শিখতে চায়। হারমোনিয়াম ঢোকাবে কোথায়? নতুন ফ্ল্যাটে গেলে না হয়...
নতুন ফ্ল্যাটে গেলে কী কী করা হবে, রাতে বসে তিন জনে বসে প্ল্যান করে।
“আমার আলাদা ঘর চাই। বন্ধুদের ডাকা যায় না...’’ টুপসির গলায় আবদার ঝরে পড়ে।
“সব হবে। আগে ফ্ল্যাটটা পাই,’’ কঙ্কা আশ্বস্ত করে।
“সবার আগে একটা বড় টিভি কিনতে হবে!’’ বিভাসের গলায় ঘোষণায় আনন্দের আভাস।
উদাস গলায় বলে কঙ্কা, “এখানে কিছুই তো হল না। ওখানে বারান্দায় টবে একটা গাছ রাখব।’’
“হবে হবে, সব হবে,’’ গলা নামিয়ে বলল বিভাস, “ভাবছি, দাদাকে যে কখন বলব!”
“সে দিন ছাদে ঘর তোলার কথা বলছিলেন দাদা। তখন বললেই তো পারতে!’’
“দূর! ও ভাবে বলা যায় না কি?”
‘‘তা ঠিক, ও ভাবে বললে ভাল দেখায় না।’’
বেরোবার প্ল্যান ক্যানসেল শুনে টুপসির মুখ বেজার হল। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। আজ ক্লাস টেস্ট আছে। জায়গার অভাবে মেয়েটার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। এ বাড়ির দক্ষিণ খোলা, বড় ঘরটা ভাশুরের। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর থেকেই ওঁর ঘরটা অভ্রর জন্য বরাদ্দ। সে ঘরে উচ্চগ্রামে গান বাজে, হুল্লোড় হয়। বাইরের ঘরে ভাশুরের বন্ধুবান্ধবরা আসেন। সেখানে চা-টা পাঠানো কঙ্কার দায়িত্ব।
বিভাস ট্রাম-বাস ঠেঙিয়ে, ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। বেশি রাত করতে পারে না। অভ্রর সময়ের কোনও ঠিক নেই। ভাশুরও দেরি করে রাতের খাবার খান। সব মিটিয়ে কঙ্কা যখন ঘরে ঢোকে তখন রাত বেশ রাত। বিভাস তো ঘুমিয়েই পড়ে। টুপসি হাই তুলতে তুলতে পরের দিনের রুটিন দেখে ব্যাগ গোছাতে থাকে।
শুধু কি তাই? বিভাসের অ্যাসিডিটির ধাত। হালকা খাবার হলে ভাল হয়। ভাশুর-জায়ের আবার একটু তেল মশলাদার না হলে মুখে রোচে না। আলাদা করে বিভাসের জন্য হালকা কিছু করা আর হয়ে ওঠে না। নতুন ফ্ল্যাটে গেলে ছিমছাম রান্না করবে। বিভাসের শরীরের দিকে নজর দিতে হবে। টুপসির পড়াশোনা, গান... অনেক স্বপ্ন গুটিসুটি মেরে মনের মধ্যে লুকিয়ে আছে।
ভাশুরকে যত্ন করে খাবার বেড়ে দিল কঙ্কা।
“বাজার পছন্দ হয়েছে তো? চিংড়িটা ভাল পেয়ে গেলাম। আর মাছের চপটা তো তোমার হাতে দারুণ হয়! তাড়াতাড়ি সেরে নাও।’’
তৃপ্তি করে খেয়ে উঠলেন ভাশুর। ‘সেরে নাও’ বললেই কি আর সেরে নেওয়া যায়? দিদির পুজো সারতে এক ঘণ্টা! চপের জোগাড়ে হাত লাগাল কঙ্কা।
ওদের বিয়ের তারিখটা বিভাস নিজের মতো করে কাটাতে চায়। কিন্তু তার উপায় নেই। সে দিন ভাশুর একগাদা বাজার করবেন। জা একটা নতুন তাঁতের শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, “আজকেই পরবি কিন্তু। আর এই পাঞ্জাবিটা বিভাসের।’’
পরা আর হয়ে ওঠে না। রান্নাবান্না করে গলদঘর্ম হয়ে কেটে যায় সারা দিন। বিভাস দেরি করেই ফেরে রোজকার মতো।
টাকাপয়সার কথা মনে আনতে ভাল লাগে না। টুপসির পড়ার খরচ বেড়েছে। লোন কাটছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাজার, আত্মীয়স্বজনদের দেয়া-থোয়া, কিছুই হিসেব মতো হয় না। ছোট ভাইয়ের উপর বড্ড ভরসা। মাসের প্রথমেই বিভাস মোটা টাকা ধরে দেয়। দাদার পেনশনটুকুই সম্বল। অভ্র গ্র্যাজুয়েশনের পর এখনও কিছু করে উঠতে পারেনি। তবে বিভাস এখান থেকে চলে যাওয়ার পরও টাকাপয়সা দেবে ঠিক করে রেখেছে।
খেয়ে উঠতে উঠতে বেলা গড়িয়ে গেল।
“একটু গড়িয়ে নিতে হবে রে। না হলে আর সন্ধেবেলা বসে থাকতে পারব না। শরীরের যা হাল!” বিপাশার গলায় ক্লান্তি।
“তুমি যাও দিদি। আমি কাজ এগিয়ে রাখি,’’ আশ্বাস দেয় কঙ্কা।
একটা অসন্তোষ সব সময় কুরে কুরে খেয়ে যায়। পছন্দমতো একটা সংসার গড়ে তোলার বড্ড শখ কঙ্কার। যেখানে কঙ্কার ইচ্ছেগুলো ফুল হয়ে ফুটে উঠবে। বিভাস দায়িত্বের চাপে নুয়ে যাবে না।
রান্না শেষ করে ক্লান্ত দেহে নিজের ঘরে যখন ঢুকল কঙ্কা, তখন দিনের আলো নিবে এসেছে। বিছানাটার তীব্র আকর্ষণ উপেক্ষা করে গা ধুয়ে তৈরি হয়ে নিল। স্কুল থেকে ফিরে মেয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। সে দিকে না তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতেই বিপাশা ধরলেন, “শরবতটা রেডি তো? ওরা এল বলে...’’
“সব ঠিক আছে দিদি। ভেবো না,’’ বলে কঙ্কা।
সমরেশদা-লগ্নাবৌদি খুব মজার মানুষ। বিদেশ থেকে বছরে এক বার আসেন। তরমুজের শরবত ওঁদের খুব ভাল লাগল।
“সব কঙ্কার হাতের গুণ! আমার দ্বারা তো কিছু হয় না!’’একগাল হেসে বললেন বিপাশা।
বিভাস এসে পৌঁছল ঘর্মাক্ত কলেবরে। ভাশুর হইহই করে উঠলেন, “এই তো আসল লোক এসে গেছে! সমরেশদা, এই যে সাজানো গোছানো সংসারখানা দেখছ, সেটা খেটেখুটে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমার ভাই। যা, তুই একেবারে হাত-মুখটা ধুয়ে এসে আমাদের সঙ্গে বোস। ঘেমে-নেয়ে গিয়েছিস তো!”
টুপসিকেও ডেকে আনলেন ভাশুর, “এই হল আমাদের সোনার টুকরো মেয়ে। লেখাপড়ায় খুব ভাল। বাধ্য, মুখে-মুখে উত্তর নেই।’’
টুপসি লজ্জা পেলেও প্রশংসার ছটায় তার মুখটা আলোকিত হয়ে উঠল। লগ্নাবৌদি বললেন, “ভারী মিষ্টি দেখতে হয়েছে।’’
বিপাশার গলায় গর্বের ছোঁয়া, “যে দেখবে সে পছন্দ করবে। তবে আমরা ওর দূরে বিয়ে দেব না।’’
ভাশুর গলা মেলালেন, “না হলে আমাদের দেখবে কে? অভ্রর তো দায়িত্বজ্ঞান একেবারেই নেই। তবে আমি ঠিক করেছি ওকে ডাক্তারি পড়াব।’’
বিপাশা যোগ করলেন, “বিয়েটা কিন্তু খুব ঘটা করে দিতে হবে।’’
“হবে হবে। একটু সবুর করো,’’ ভাশুরের মুখটা খুশিতে জ্বলজ্বল করতে লাগল।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে খেতে বসিয়ে দিল কঙ্কা। প্রশংসার ঝড় বয়ে গেল। ভাশুরের কথা আর শেষ হতে চায় না।
“বৌমা আমার রান্নায় দ্রৌপদী। এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে না, অন্য হাতের রান্না মুখে রোচে না। আর মালাইকারিটা হল ওর স্পেশ্যালিটি।’’
কঙ্কার দিকে তাকিয়ে হাসেন বিপাশা, বলেন, “অভ্রর যত বায়না সব কাম্মার কাছে। আর আমি তো নিজের ওষুধটাও খেতে ভুলে যাই। কঙ্কাই মনে করিয়ে দেয়।’’
লগ্নাবৌদি বলেন, “তোমাদের বাড়ি এলে খুব ভাল লাগে। কেমন সুন্দর আছ তোমরা!”
“অল ক্রেডিট গোজ় টু আমার বৌমা। ও দু’চারদিন না থাকলে আমরা চোখে অন্ধকার দেখি!’’ ঘোষণা করলেন ভাশুর।
ঘামে ভেজা কাপড়টা ছেড়ে ঘরে গিয়ে কঙ্কা দেখল, বিভাস বসে সিগারেট খাচ্ছে।
“মাসদেড়েকের মধ্যেই শিফ্ট করা যেতে পারে। কিন্তু... কী করে যে দাদাকে বলব!” বিভাসের গলায় অসহায়তা।
“বলতে হবে না,’’ উত্তর দিতে দেরি হয় না কঙ্কার।
“তার মানে?” অবাক হয় বিভাস।
“ছেড়ে দাও।’’ কঙ্কার কণ্ঠস্বর যেন দূর থেকে ভেসে এল।
বিভাস আস্তে আস্তে বলল, “আমি যে টাকাপয়সা সব...’’
“টাকাপয়সায় কি সব হয়? এই বাড়িটা, বাড়ির সবাই... বড্ড মায়া... বড্ড টান...’’ কঙ্কার গলা ভিজে এল।
নিঝুম পৃথিবী যেন নীরব সমর্থনে কঙ্কার অনুভূতি ভাগ করে নিল।