সমরেশ দত্ত এখন ইলেকট্রিক চুল্লিতে পুড়ছে। শ্মশানের একটা বেঞ্চে বসে সমরেশের পাড়া-প্রতিবেশী আর কিছু আত্মীয়-বন্ধু। চুল্লি থেকে ওর ভস্ম হয়ে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় ঘন ঘন সময় দেখছে। একটু পরেই নদীতে সেই ভস্ম চিরকালের মতো বিলীন হয়ে যাবে।
চুল্লির চিমনি থেকে অনর্গল পাক খেয়ে উঠে যাওয়া ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলল নিমগ্ন। সমরেশের শান্ত, দৃঢ় মুখচ্ছবিটা বার বার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠতেই একটা অসহনীয় কষ্ট বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠে এল নিমগ্নর কণ্ঠনালী পর্যন্ত।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই সমরেশের লেখার হাত ছিল বেশ ঈর্ষণীয়। বন্ধুদের নিয়ে নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করাই ছিল সমরেশের একমাত্র নেশা। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাণিজ্যিক সব পত্রপত্রিকায় লেখালিখির বন্ধুর পথও একটু একটু করে মসৃণ হচ্ছিল ওর সামনে। এমনকী বড়-ছোট নির্বিশেষে যে কোন সাহিত্য পত্রিকার গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়াটাও সমরেশ প্রায় অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল। আর তা নিয়েই অন্য বন্ধুদের গোপন হিংসার শিকার হয়েছিল সে। সুতরাং, প্রিয় বন্ধুদের বিচ্ছেদে সমরেশ তখন অনেকটাই একা। কেবল নিমগ্নই কোনও দিন ছেড়ে যেতে পারেনি সমরেশকে। আসলে, একটা আশ্চর্য বিশ্বাসের মোড়কে নিরাপদ ছিল সমরেশ-নিমগ্নর বন্ধুত্ব। সমরেশের লেখক সত্তার পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল নিমগ্নর সাহচর্যে। শেষে লেখাটাই হয়ে উঠেছিল ওর জীবনের এক মাত্র ধ্যান- জ্ঞান। যথেষ্ট মেধা শক্তি থাকা সত্ত্বেও সমরেশ কখনও চাকরির চেষ্টা করেনি। বরং, যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাকেই ও ‘বোগাস’ মনে করে অনেকটা স্বস্তিতে দিন কাটিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত লেখক হওয়ার জন্য দিনরাত ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছে সমস্ত অলসতা বর্জন করে। ইউনিভার্সিটিতে সুতপার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরও সমরেশের সেই মানসিকতার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
প্রথম দিকে সুতপা কর্মহীন সমরেশের লেখক হওয়ার পাগলামিকে পূর্ণ সমর্থন করলেও ওদের বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই লেখালিখিকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় নিত্য অশান্তি। শেষে সমরেশের অনুপস্থিতিতে এক দিন সুতপা নিমগ্নকে ফোন করে ডেকে অকপটে বলেছিল, ‘‘নিমগ্ন, তোর বন্ধু লেখালিখিটা নিয়ে এক্সট্রিম পর্যায়ের বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। আমাকে একটুও সময় দেয় না সেটা নাহয় মুখ বুজে মেনে নিলাম, কিন্তু যে কুড়ি-পঁচিশ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে কোনও রকমে এই সংসারটা চলছে সেখানে ফাঁকি দিলে কি চলে?’’
প্রশ্নটা যে অত্যন্ত সঙ্গত এবং উদ্বেগের, তা উপলব্ধি করেও নিমগ্ন সুতপাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, ‘‘আহ, অত দুশ্চিন্তা করছিস কেন? সমরেশ তো এখন উঠতি প্রতিভাবান লেখকদের মধ্যে এক জন। আর ক’দিন অপেক্ষা করলেই হয়তো দেখবি ওর এই খ্যাতির সঙ্গে অর্থও চলে আসবে স্রোতের বেগে। তখন তোদের স্টেটাসই বদলে যাবে।’’
নিমগ্নের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সুতপা বলেছিল, ‘‘কিন্তু সে সবই তো ভবিষ্যৎ। তার আগে বর্তমান পরিস্থিতিটা সামাল দেব কী ভাবে, সেই ভেবেই আমার রাতের ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছে। টিউশন করতে বসেও ও যদি জাস্ট লেখার ভাবনাতেই ডুবে থাকে, তবে ছেলেমেয়েদের শেখাবেটা কী, আর ওরাই বা টিকবে কেন?’’
‘‘‘সত্যিই এটা চিন্তার বিষয়। আচ্ছা ঠিক আছে, ব্যাপারটা নিয়ে সমরেশের সঙ্গে আমি কথা বলব।’’ কিন্তু সুতপাকে আশ্বস্ত করলেও সমরেশের সঙ্গে নিমগ্ন কোনও দিনই সে বিষয়ে কোনও কথা
বলার চেষ্টা করেনি। সমরেশও নিজেকে পালটায়নি। তবে এর বছর দুয়েকের মধ্যেই নিমগ্নর ভবিষ্যদ্বাণীটা একশো ভাগ মিলে গিয়েছিল। বাংলার প্রথম সারির সব পত্রপত্রিকা থেকে নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হওয়ার সুবাদে আর্থিক দীনতা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেছিল সমরেশ। সুতপা তখন পরম তৃপ্ত। কথা বলার সময় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটত ওর শান্ত দু’টো চোখে।
নিমগ্নর মনের ভিতরও আশৈশব লালিত লেখক হওয়ার অদম্য ইচ্ছেটার কথা একমাত্র সমরেশই জানত। কলেজে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর পর্যন্ত কোথাও প্রকাশিত না-হওয়া নিমগ্নর অসংখ্য গল্পের প্রথম পাঠক ছিল সমরেশই। সমরেশের অন্ধ প্রশ্রয়ই নিমগ্নকে দিনে দিনে ক্রমশ নির্লজ্জ করে তুলেছিল। মাঝে মাঝেই তাই এক-আধটা গল্প খামে ভরে নিঃসঙ্কোচে সমরেশের কাছে গিয়ে বলত, ‘‘তুই যে সব পত্রিকায় লিখছিস, সেখানে আমার এই লেখাটা পাঠালে কেমন হয়?’’ প্রশ্নটা শুনেই সমরেশ উচ্ছ্বাসভরা গলায় বলত, ‘‘গ্রেট থট। রিয়্যালি গ্রেট থট। এ ভাবেই তো হয়।’’ তা ছাড়া নিমগ্নর অনেক গল্পই পত্রিকা দফতরগুলোতে পাঠানোর আগে সমরেশ নিজে তা পরিমার্জন করে দিয়েছে। লেখার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছে নিমগ্নকে। সমরেশের সেই অকৃপণ উদারতায় নিমগ্ন মুগ্ধ হয়ে যেত। যদিও নিরলস চেষ্টাতেও নিমগ্নর একটা লেখাও কোনও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। নিরন্তর ব্যর্থতার গ্লানি আর লজ্জায় নিমগ্ন যখন একেবারে মুষড়ে পড়েছিল তখন সমরেশই ওর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘‘দেখবি, তোর লেখক জীবনের শুরুটা যেমন দেরিতে হচ্ছে, শেষটাও তেমন দীর্ঘস্থায়ী হবে। আমার থেকেও তুই লম্বা ইনিংস খেলবি।’’
সমরেশের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে সেই কথাগুলোকেই নিমগ্ন বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করেছে। তার পর একটা সময় সমরেশকেই ও সবচেয়ে বেশি হিংসা করতে শুরু করেছিল। সমরেশের কোনও ফোন এলেই ওর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠত। কারণ, সমরেশ ওর লেখা বেরনোর খবর জানিয়ে প্রায়ই নিমগ্নকে ফোন করে বলত, ‘‘কাল আমার লেখাটা পড়িস। ‘স্বদেশ’ থেকেই বেরবে। আর পরের বার তোরও একটা লেখা বেরনোর অপেক্ষায় রইলাম।’’
সমরেশের সেই কথাগুলো নিমগ্নর কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতোই মনে হত। অথচ সমরেশ নিমগ্নর প্রতি তখনও আগের মতোই উদার ছিল। আগের মতোই বন্ধুকে নিত্য তাগাদা দিয়ে গল্প লিখতে প্রেরণা জোগাচ্ছিল। এত সব সত্ত্বেও এক দিন হঠাৎ লেখক হওয়ার ইচ্ছেটাকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে নিমগ্ন কলম ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। শুধু থেমে থাকেনি সমরেশ। সহজাত উদ্ভাবনীশক্তি নিয়ে ও লিখে গিয়েছে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত।
সমরেশের গোটা শরীরটা ভস্ম হয়ে একটা বড় অ্যাশট্রেতে করে বেরিয়ে এল ইলেকট্রিক চুল্লি থেকে। মুহূর্তেই একটা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল নিমগ্নর। শ্মশানের এক বয়স্ক ডোম অত্যন্ত নির্বিকার ভাবে জানিয়ে গেল, ‘‘অস্থিতে জল দেওয়া হয়ে গেলে ছাই-টাই সব গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন।’’ কথাটা শুনেই নিমগ্নর দু’চোখ ছাপিয়ে জল নেমে এল। অন্তিম বারের মতো সমরেশের সঙ্গে সমস্ত রকম সম্পর্কের ছেদ পড়বে এ বার।
শ্মশান থেকে নিমগ্ন যখন বাড়ি ফিরল, তখন প্রায় সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছে। এখন শরীর আর মন, দু’টোই কেমন যেন বিবশ হয়ে আছে ওর। বোধশূন্য হয়ে নিমগ্ন একটা চেয়ার টেনে টেবিলে মাথা গুঁজে বসে পড়ল। হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠল ওর। মাথা তুলে নিমগ্ন দেখল, মোবাইল স্ক্রিনে সুতপার নাম ভেসে উঠছে। তড়িঘড়ি ফোনটা রিসিভ করতেই ফোনের ও প্রান্ত থেকে সুতপা আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘‘নিমগ্ন, কাল সময় করে অবশ্যই এক বার আমার সঙ্গে দেখা করিস। ভীষণ জরুরি কথা আছে।’’ ‘‘কী কথা? ফোনে বলা যাবে না?’’ নিমগ্নর প্রশ্নের উত্তরে সুতপা গলার স্বরটা যতটা সম্ভব নামিয়ে বলল, ‘‘বিষয়টা একটু অন্য রকম। কাল তুই এখানে এলে সব বলব।’’
‘‘ঠিক আছে। কাল আমি অফিস থেকে ফেরার সময় এক বার যাব।’’ কথা সংক্ষিপ্ত করে ফোনটা রেখে দিল নিমগ্ন। কিন্তু সে বুঝতে পারছে, ওর মানসিক চঞ্চলতা হঠাৎ করেই যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সুতপার কী এমন ‘অন্য রকম’ কথা থাকতে পারে যেটা ফোনে বলা গেল না! সমরেশের পারলৌকিক কাজকর্মের বিষয়ে পরামর্শ করতে, না কি ও টাকাপয়সা কোথায় কী জমিয়ে রেখে গিয়েছে, তার ডকুমেন্টগুলো দেখাতে চাইছে সুতপা? কিন্তু তার জন্য এত
তাড়া কিসের? নানান সরল ও জটিল প্রশ্নে নিমগ্নর মনের অস্থিরতা বেড়েই চলল ক্রমশ।
শরীরে কেমন যেন একটা শিরশিরানি ভাব অনুভব করছে নিমগ্ন। রাতের খাবার না খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। সারা দিনের দৌড়ঝাঁপের ক্লান্তিতে শরীর এখন বেশ বিধ্বস্ত, তবু চোখে ঘুম নামছে না। বরং মনে পড়ছে মৃত সমরেশের বিবর্ণ মুখের ছবিটা।
ঘুম থেকে উঠতে সকাল ন’টা বেজে গেল নিমগ্নর। সমরেশের মৃত্যুর চব্বিশ ঘণ্টা না পেরোতেই কী কথা বলতে চায় সুতপা, সেটা এখনই জেনে আসা উচিত। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই সমরেশের বাড়ি এসে পৌঁছল সে।
সমরেশদের বাড়ির বারান্দায় দু-এক জন অপরিচিত মহিলা অবিন্যস্ত ভাবে বসে আছে। দৃশ্যটা দেখে বেশ বিব্রত বোধ করছে নিমগ্ন। সে ফিরে যাওয়ার উপক্রম করতেই সুতপার শান্ত গলার স্বর ভেসে এল, ‘‘চলে যাচ্ছিস যে, ভিতরে আয়।’’
শাঁখা-সিঁদুর নেই, পরনে সাদা শাড়ি। এক দিনেই এমন হতশ্রী অবস্থা! কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীর পায়ে ঘরে ঢুকতেই সুতপা একটা লাল রঙের বক্স ফাইল তুলে দিল নিমগ্নর হাতে। ‘‘কী আছে এতে?’’ নিমগ্নর উদ্বেগ-ভরা প্রশ্ন শুনে সুতপা বলল, ‘‘গত পরশু দিন সকালে সমরেশের রোড অ্যাক্সিডেন্টের পর ওকে নার্সিং হোমে অ্যাডমিট করিয়ে বাড়ি ফিরেই চিকিৎসার খরচের জন্য ফিনানশিয়াল কিছু কাগজপত্র খুঁজতে এই ফাইলটা চোখে পড়ে। ভাবলাম আমি যা যা খুঁজছি তা হয়তো এই ফাইলটাতেই আছে। কিন্তু ফাইলটা খোলা মাত্রই...’’
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সুতপা আবার বলল, ‘‘যাই হোক, ফাইলটা তুই নিজে দেখ।’’
সুতপার চোখের ইশারায় নিমগ্ন ফাইলটা খুলে দেখল, বেশ কিছু খাম। খামগুলো সে চিনতে পারল। কয়েক বছর ধরে এগুলো সে সমরেশের হাতে দিয়েছিল, বিভিন্ন পত্রিকার দফতরে পাঠানোর জন্য। সব খামের মুখ ছেঁড়া। নিমগ্ন বুঝতে পারল, অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই সমরেশ সমূলে নষ্ট করেছে ওর স্বপ্নের বীজ।
ফাইল থেকে একটা একটা করে খাম দেখতে দেখতে চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে গেল নিমগ্নর। হঠাৎ টের পেল, একটু বেশিই যেন ওর শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সুতপা।
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: [email protected] সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।