জলঢোঁড়া.md
জলঢোঁড়া.md
মুহূর্তের মধ্যে দিগন্তর মনে পড়ে যায় মায়ের মুখে শোনা একটা কথা। তার ঠোঁটদুটো মৃদু ফাঁক হলে শ্রাবণীদি শুনতে পায় দিগন্ত বলছে, “হরির উপরে হরি, হরি শোভা পায়, হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়।”
এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে সে দিগন্তর দিকে তাকিয়ে বলে, “এই, তুই কী বললি রে?”
দিগন্ত একটা ছোট ইটের টুকরো জলে ছুড়ে বলল, “এটা একটা অদ্ভুত ধাঁধা। সবই হরির রূপ! খাদ্য-খাদকও হরি। আর যেখানে ওরা আশ্রয় নিচ্ছে সেটাও হরি,” দিগন্ত মৃদু হাসে।
ঠোঁট উল্টে শ্রাবণীদি বলল, “মাঝে-মাঝে তোকে বড় অদ্ভুত মনে হয়! তোর কথার কোনও থই পাই না! যেন তুই এ জগতের কেউ নোস! তোকে ভীষণ অচেনা মনে হয়।”
“আচ্ছা, তুমি তো আমারই বয়সি, তাই না?” দিগন্ত ইচ্ছে করেই ‘শ্রাবণীদি’ বলে সম্বোধন করল না।
“আবার সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছিস! কত বার বলেছি আমি তোর থেকে সামান্য হলেও বড়।”
দিগন্ত শ্রাবণীদির ডান হাতটা নিজের করতলে নিয়ে খেলা করে। ইচ্ছে করে সাপের মতো বড় নিঃশব্দে জাপটে ধরতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এই সমাজ তা হতে দেবে না। আরও কিছু বিনিদ্র রাত তাকে জাগতে হবে। গুমরে-গুমরে মরতে হবে। তবু এই পোড়া সমাজের ঘুম ভাঙবে না!
এ সবই বেশ অনেক দিনের কথা। তখন ছোটবেলা। এই গ্রামের চার দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির মধ্যেই দিগন্ত ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল। নিত্যনতুন দুরন্তপনা ছিল সঙ্গী। লোকের বাগান থেকে ফল চুরি, রাতের অন্ধকারে পুকুর চুরি আবার পৌষের ধান কাটা হয়ে গেলে ওই ফাঁকা মাঠে গরুর গাড়ির ছইয়ের নীচে মোটা করে খড় পেতে একটা অনুজ্জ্বল লন্ঠনের আলোয় বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলা। আর আকাশের নীচে সব বন্ধুদের বাড়ি থেকে চাল-ডাল-আলু এবং মাত্র দু’টাকা করে চেয়ে নিয়ে ডিম কিনে পৌষালু করার মধ্যে এক আশ্চর্য আনন্দ লুকিয়ে থাকত। এ ব্যাপারে বাড়ির কোনও শাসন ছিল না।
আর ঠিক এই বয়সেই শ্রাবণীদিরা এই গ্রামে এল। ওর বাবার বদলির চাকরি। আসলে গ্রামটা ঠিক অন্য সব গ্রামের মতো ছিল না। প্রাথমিক ও হাই স্কুল ছিল। একটা হাসপাতাল আর থানাও ছিল। রোজ সকালে মাত্র আধ মাইল দূরে একটা বাজারও ছিল। বেড়ে ওঠার পক্ষে এটাই ছিল যথেষ্ট। আর ছিল আদিগন্ত বিস্তৃত ঘন সবুজ জমি দিয়ে ঘেরা সেই গ্রাম।
দিগন্ত বার বার মনে মনে গ্রামটাকে সবার ভাবলেও, আসলে গ্রামবাসীদের চোখে বাইরে থেকে আসা মানুষরা ছিল বিদেশি মানুষ। ওরা বলত, ‘বিদেশি মানুষের সঙ, হলদি রঙের রঙ।’ আসলে সবটাই যে ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার, সেটা বোঝানোর জন্যই এমন গ্রামীণ কথার ছল। এটা অবশ্য দিগন্ত বড় হয়ে বুঝতে পেরেছে। তত দিনে অপরেশকাকুর মেয়েকে গ্রাম চেনানোর দায়িত্ব পড়েছে দিগন্তর উপর। অপরেশকাকু ছিলেন বাবার সান্ধ্য তাস খেলার সঙ্গী। তাদের কোনও কোয়ার্টার ছিল না। যেমন দিগন্তদেরও ছিল না। গ্রামের লোকের বাড়িতে ভাড়া থাকতে হত। একমাত্র হাসপাতালের ও থানার সব কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। আর তাই অপরেশকাকুও পাশের বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন। অনেক অনটনের মধ্যেও সে দিনগুলো বড় সুখের ছিল। বাড়ির সকলের সঙ্গে একটা গোটা ডিমকে সুতো দিয়ে কেটে ভাগ করে খাওয়ার মধ্যে গভীর আনন্দ লুকিয়ে থাকত। শেষ পাতে হাঁসের অর্ধেক ডিমের কুসুম চেটে খাওয়ার ছবিটা দিগন্ত এখনও স্পষ্ট দেখতে পায়।
যে দিন ডলিকাকিমা দিগন্তকে ডেকে বললেন, “দিগন্ত, তুমি আমার সাবু, মানে শ্রাবণীকে এক দিন এই গ্রামটা ভাল করে ঘুরিয়ে দেখিয়ো। এখানে যখন থাকতেই হবে, তখন আগে গ্রামটাকে এক বার নিজের চোখে দেখে নেওয়া উচিত। ও তোমার থেকে সামান্য বড় হলেও তোমার সঙ্গে ক্লাস ফাইভে পড়বে। ওকে দিদিই বলবে, কেমন?”
দিগন্ত আজ বুঝতে পারে, সে দিনের ডলিকাকিমার কথার মধ্যে একটা কেমন যেন অনুশাসনের প্রচ্ছন্ন আভাস ছিল। যত বারই সে, শ্রাবণীদি আর নিজের মাঝের ওই অনুশাসনটা ভাঙতে চেয়েছে, তত বারই কাকিমা যেন ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আর তাই কোনও দিনই তা ভাঙা হয়নি।
শ্রাবণীদির সুন্দর ফ্রকের নীচে ফর্সা নগ্ন পা দুটো ছিল বকের মতো লম্বা। আর ফ্রকের হাতা ছিল ঘটিহাতা। ডলিকাকিমা হাতমেশিনে বানিয়ে দিতেন। তাই সে নিত্যনতুন ফ্রক পরে স্কুলে আসত। লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যেত। সারা শরীর থেকে অদ্ভুত অচেনা মিষ্টি সুবাস বেরোত। অনেককেই শ্রাবণীদি কাছ দিয়ে চলে গেলে নাক টেনে গন্ধ নিতে দেখেছি। গন্ধটা কিসের, জানতে চাইলে শ্রাবণীদি মুচকি হেসে এড়িয়ে যেত। এক দিন একান্তে ফিসফিস করে বলেছিল, “বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রাখি। তাই অমন গন্ধ। তোকে এক দিন দেখাব।”
সে দিন শ্রাবণীদির কথার গূঢ় অর্থ আমার মোটা মাথায় ঢোকেনি। আমি বুঝতে পারিনি রুমাল আবার দেখানোর আছেটা কী! যদিও তখনও আমার কোনও রুমাল ছিল না। বাবার শার্টের পকেটে একটা সাদা রুমাল থাকতে দেখেছি। কিন্তু তাতে সব সময় নস্যির দাগ লেগে থাকত। আমাদের স্কুলের পণ্ডিতমশাইয়ের মতো বাবাও নস্যি টানতেন। তবে পণ্ডিতমশাই নিতেন ভারী সুগন্ধি এক নস্যি। অনেক দিন তিনি শব্দরূপ লিখতে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন, আমরা তাঁর টেবিলে রাখা ঢাউস কৌটো থেকে নস্যি চুরি করতাম। আজ তা ভাবলে মনের মধ্যে একটা অন্যায় বোধ কাজ করে।
এক জন সদ্য নারী হয়ে ওঠা মেয়ের আঙুলের সঙ্গে নিজের আঙুলের প্রথম স্পর্শ হলে শরীরের ভিতরটা যেন কেমন করে ওঠে! বহু বার শ্রাবণীদির শুধু আঙুল নয়, তার করতলও আমার করতলে আত্মগোপন করেছে। অথচ সে দিন ও সবের কোনও বিশেষ অনুভূতি ছিল না। তবে তত দিনে আমার ‘গোরা’ পড়া হয়ে গিয়েছে। স্কুলে গিয়ে বই চাপা দিয়ে পড়তাম। শ্রাবণীদিই আমাকে পড়তে বলেছিল। আমরা দু’জনেই তখন ক্লাস এইটে। ললিতার থেকে সুচরিতাকে বেশি মনে ধরেছিল। মনের মধ্যে অমন একটা তীক্ষ্ণ ডাগর চোখের চাউনি অনুভব করতাম। আর সেখানে বসিয়ে দিতাম শ্রাবণীদিকে। সারা শরীরে একটা শিহরন খেলে যেত। আমি সুচরিতার মধ্যে ক্রমশই তলিয়ে যেতাম। যেমন শ্রাবণীদি তলিয়ে যেত গোরার মধ্যে।
বহু দিন হল আমরা সবাই গ্রাম ছেড়েছি। বাবার সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে এখন শহরবাসী। আর আমি চলে গিয়েছি একেবারে দেশের বাইরে। বছরে এক বারের বেশি বাড়ি আসা হয় না। শুনেছি শ্রাবণীদির বাবাও অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। কিন্তু শ্রাবণীদি যায়নি। অথচ কেন যায়নি, তার ইতিহাস জানতে আর এক বার ফেলে আসা স্মৃতির ঝাঁপি খুলতেই চলেছি সেই অখ্যাত গ্রামে।
জানতাম কোনও গ্রামই আগের মতো থাকে না। খরবাও এগিয়ে এসেছে বড় রাস্তার কাছে। মাটির অনেক বাড়ি আজ পাকা। গ্রামের শেষ প্রান্তে বিশাল আমবাগানটা আর নেই, ধানি জমি হয়ে গেছে। যে গাবগাছটা তখনই ছিল একশো বছর বয়সি, সেটাও পলকা ঝড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল জলপাই-চালতা গাছগুলোও।
আমাকে তেমন ভাবে কেউ চিনতে পারেনি। তবে গ্রামের মানুষের কৌতূহল বেশি বলেই তারা সুদেবের চায়ের দোকান থেকে বার বার উঁকি মেরে আমাকে দেখছিল। আমি একা একাই ঘুরছিলাম। অবাক হলাম থানার কাছে এসে। না আছে থানা, না আছে হাসপাতাল! একটা হয়ে গেছে ফাঁড়ি, আর একটা হেলথ সেন্টার। এ ভাবে ওদের অপভ্রংশ হয়ে যেতে দেখে আমার বুকটা টনটন করে উঠল।
দু’-এক জনকে জিজ্ঞেস করতেই বুঝতে পারলাম শ্রাবণীদি কোন বাড়ির বৌ হয়েছে। তাই আমার সেই বাড়িটা চিনে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। শরিকি ভাগ হতে হতে এখন এক চিলতে হয়ে গেছে। বাঁশের বাতার বেড়া ঠেলে আঙিনায় পা দিতেই দেখি এক জন বয়স্কা মহিলা তুলসীতলায় গোবর লেপছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় সে মাথা তুলে আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে দাঁড়াল। অস্ফুট স্বরে জানতে চাইলাম এখানে শ্রাবণীদি বলে কেউ থাকেন কি না। মহিলা কিছু না বলে গোবরের হাঁড়িটি নিয়ে চলে গেলেন। কুয়োতলায় হাত ধুয়ে আবার ফিরে এসে বললেন, “আপনি কার নাম বললেন?”
তা হলে কি ভুল বাড়িতে এলাম! আমি বললাম, “কেন, শ্রাবণীদি!”
মহিলা এ বারও কোনও কথা না বলে দাওয়ায় হেলান দিয়ে রাখা পাটিটা পেতে বললেন, “বসুন।”
আমি বসলাম বটে, তবে আমার অশান্ত চোখ দুটো বাড়ির আনাচে-কানাচে সেই পরিচিত মুখটাকে খুঁজে চলেছে। সারা বাড়িটাই বড় নিস্তব্ধ। যেন এই মুহূর্তে বাড়িতে আর কেউ নেই। মহিলা এসে পাটির এক কোণে বসে বললেন, “আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আর কেনই বা শ্রাবণীর খোঁজ করছেন?”
সব মানুষেরই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর ভাঙে-গড়ে। কিন্তু এ স্বর আমার পরিচিত! তবু আমি বললাম, “আমি আপাতত কলকাতা থেকে আসছি। আমি দিগন্ত।”
হঠাৎ দমকা বাতাসে যেমন গাছের শুকনো পাতা খসে পড়ে, তেমন করেই সেই মহিলার মাথার সাদা ঘোমটা খসে গেল। উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সেই দুটো ডাগর চোখ। আমার কাছে এসে হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি জানতাম, তুই এক দিন আমার খোঁজে আসবি! সেই এলি, যখন আমি ফুরিয়ে গিয়েছি।”
একে একে সব শুনলাম। আমরা চলে যাওয়ার পর শ্রাবণীদি গ্রামের এক স্বাস্থ্যবান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। বুড়ো কালীর মন্দিরে বিয়ে করেছিল ওরা। আর তাই লজ্জা-ঘৃণায় অপরেশকাকু এখান থেকে বদলি নিয়ে চলে যায়। কিন্তু সেই গোরার মতো পেটানো চেহারার সুকুমার সাত দিনের বেশি বাঁচেনি। সাপে কেটেছিল। নিজেদের বাড়ির পুকুরে। ওটা জলঢোঁড়া নয়, বিষাক্ত কিছু ছিল।
শ্রাবণীদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “তুই কিন্তু সেই জলঢোঁড়াই রয়ে গেলি। কোনও দিন বিষাক্ত সাপ হতে পারলি না রে দিগন্ত।”
আমি চমকে উঠলাম। আমাদের দু’জনের বয়সের ভারে চুলে পাক ধরেছে। তবু খুব কাছ থেকে আমি যেন আজও শ্রাবণীদির বুকের খাঁজে রাখা সুগন্ধি রুমালের গন্ধ পেলাম।