পাড়াগাঁয়ের সাধারণ মানুষ। কানে তার একটা বিড়ি গোঁজা থাকারই কথা। এর কানে রয়েছে পেনসিল। বোঝা যায়, পেনসিলটার ব্যবহার হয়। সে নিরক্ষর মানুষ। পেনসিল নিয়ে কী করবে! অথচ কাগজ-পেনসিল ছাড়া তার চলে না। রুল টানা নয়, একটা সাদা খাতা সব সময় তার সঙ্গেই আছে। গৌরবর্ণ সুপুরুষ মানুষটি মাথাভরা টাক, ঘাড়ের ওপর সামান্য কিছু কাঁচা-পাকা চুল, দাড়ি-গোঁফ কামানো। রেশনের দোকানে একমুঠো চিনি খেতে চেয়েছিল বলে গাঁয়ের সেরাজুল কিছু অ্যামোনিয়া সার তার মাথায় দিয়ে দিয়েছিল। মানুষটি ভেবেছিল, চিনিই যখন, তখন টাক মাথায় কেন। মাথায় হাত বুলিয়ে হাতটা মুখে দিয়ে দেখে বিচ্ছিরি নোনতা। এতেও কিন্তু সে রাগ করে না। চোখ কুঁচকে হাসে।
আজকের এই পড়ন্ত বিকেলে সে বলছে, ‘তুমি তো বড় ভাবনায় ফেলে দিলে পণ্ডিত। মাটির বাড়িই তো বানাবে, তাতে এত কথার কী আছে? এই যে খাতা এনেছি, তুমি যেমন চাও বলো, আমি খাতায় এঁকে দিচ্ছি।’
না, না, ওভাবে হবে না হানিফ। আমি একদম আলাদা একটা বাড়ি বানাব।
তা বানাও না। ঘর বেশি চাই? বলো, কটা ঘর চাই? পাশাপাশি পাঁচটা ঘর বানিয়ে দিচ্ছি।
আরে না। মাটির বাড়িই করব বটে, তা এমন বাড়ি, যা এ তল্লাটে আর একটাও নেই।
কোঠাবাড়ি বলছ?
দূর, দোতলা কোঠাবাড়ি তো হবেই। তিনতলা করব আমি।
কী যে বলো পণ্ডিত! তিনতলা মাটির বাড়ি? এখানে কেউ এ রকম করেছে নাকি?
করে নাই বলেই তো করে দেখিয়ে দেব।
তোমার ওই পাঁচিল ঘেরা জায়গাটা ক’ কাঠা? পুরো সাড়ে ছয় কাঠা। বিনোদবাবুর কাছ থেকে যখন কিনি, তিনি নিজে মেপে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। দুটো ঘর ওখানে আগে থেকেই ছিল। এখন নেই, ভেঙে দিয়েছি। এখন সাড়ে ছ’ কাঠাই একেবারে সমান। কোথাও একটুও টইটক্কর নেই। দুই কোণে দুটো ডুমুর গাছ, পুবের দেয়াল ঘেঁষে একটা পেয়ারাগাছ ছাড়া আর কিছুই নেই এখন।
তা যত বড় বাড়িই করো, অত জায়গা তো লাগবে না।
বাড়ি বাদ দিয়ে সবটাই ফাঁকা উঠোন হবে। এখন সেখানে দূর্বাঘাস, কাঁটালতা, নটেশাক—এই সব আছে। বাড়ি করার জন্যে একেবারে তৈরি জমি।
এখন বলো পণ্ডিত, কেমন বাড়ির কথা ভাবছ তুমি? ইট-বালি-সিমেন্টের বাড়ি নয়, মাটিরই বাড়ি? তুমি হচ্ছো দশ গাঁয়ের মাথা, তোমাকে ভয়ও করি, মান্যও করি। তুমি একটা কথা বললে অমান্যি করার ক্ষ্যামতা নাই কারও।
হানিফ, তুমিও সামান্য লোক নও। তুমি হচ্ছো কারিগর। এলেবেলে ঘরামি নও। দালানকোঠা তো তুচ্ছু কথা, তার কত মিস্ত্রি আছে, লেখাজোখা নেই। তোমার মতো মাটির কারিগর কি আর আছে? তোমার তৈরি মাটির বাড়িও এক শ বছর টিকবে।
তা আমাদের এই এলাকায় মাটিটা ভালো বটে। সব রকমই পাওয়া যায়। দেয়াল করার জন্যে এঁটেল মাটি তো আছেই, একটু দেখেশুনে আনলে বেলে মাটিও মেলে। লাল মাটিটাই এদিকে নাই। তবে তার দরকারই বা পড়ছে কেন? ঘরের ভেতরে দেয়াল পলেস্তারা করার জন্যে ওই এঁটেল মাটির সঙ্গে বেনাঘাস মিশিয়ে নিলেই তো হলো। লাল মাটির কোনো দরকারই নেই। এঁটেল মাটির দেয়াল ইট-সুড়কির গাঁথনির চেয়েও ভালো।
ঘরের ভেতরের দিকের দেয়ালে বেলে মাটির পলেস্তারা হবে। মওলা বখশ খুব সময় নেয় বটে, কিন্তু কাজ করে নিখুঁত। দালানবাড়ির বালি-সিমেন্টের পলেস্তারার চেয়েও ওর বেলে মাটির পলেস্তারা ভালো। মিস্ত্রিখরচ একটু বেশি লাগবে, এই যা। তা জীবনে এমন বাড়ি তো একবারই করব!
তা পণ্ডিত, একটা কথা শুধুই! রাগ করবে না তো?
না, না, বলো, রাগ করব কেন?
তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের বিরাট সংসার এক হেঁশেলেই চলছে। তোমার বিধবা বোনটাই সংসারের কর্ত্রী। তাহলে আবার একটা আলাদা বাড়ি কেন?
শখ, হানিফ, শখ। সব মানুষেরই একটা করে শখ থাকে না? আমারও শখ এমন একটা বাড়ি করব। হ্যাঁ, মাটির বাড়ি। এ তল্লাটে এ রকম আর একটাও মিলবে না।
আলাদা হেঁশেল হবে না বলছ?
আরে না, না। করা রইল আরকি বাড়িটা। থাকুক খালি পড়ে। কখনো বাস করতে হলে করা যাবে।
তোমার ভাইয়েরা কিছু...
আমার ভাইদের তুমি চেনো না? আমার চৌদ্দ বছর বয়েসে বাপ মারা গিয়েছিল। ছোট ভাইয়ের বয়েস তখন এক বছরও হয়নি। আমি তো ওদের বাপ।
না, না, পণ্ডিত, কিছু মনে কোরো না। আমি জানি, তোমার ভাইয়েরা কী চোখে দেখে তোমায়। এখন বলো, কী রকম বাড়ির কথা ভাবছ?
শোনো, মাটির বাড়িতে পাশাপাশি অনেক ঘর তো থাকতেই পারে। আমি চাই, ঘরের ভেতরে ঢুকে আবার আরেকটা ঘর।
ও রকম হবে কী করে মাটির বাড়িতে? ইটগাঁথা পাকা দালানবাড়িতে অমন হতে পারে।
না হানিফ, মাটির বাড়িই চাই ও রকম। এক দিকে এ রকম দুটো ঘর, অন্য দিকে আবার দুটো ঘর। মাঝখানে সিঁড়ি। সিঁড়িটা পাকা হবে। দোতলায় আবার এক দিকে দুটো ঘর, আরেক দিকে দুটো ঘর। একতলা, দোতলা মিলিয়ে মোট আটটা ঘর। তেতলায় সব মিলিয়ে একটা হলঘরের মতো।
পণ্ডিত, এ রকম বাড়ি আমি কোনোদিন বানাইনি। পাশাপাশি ঘর চাও, তা হবে। কিন্তু একতলায় দুই দুই চার, আবার দোতলায় দুই দুই চার; মোট আটটা ঘর, আবার তেতলায় একটা বড় ঘর। না পণ্ডিত, এ সম্ভব হবে না। তারপর বারান্দা তো থাকবেই।
হ্যাঁ, চওড়া বারান্দা পাকা হবে। তার মানে বারান্দা আর সিঁড়ি পাকা হবে। দোতলাতেও বারান্দা হবে একই রকম চওড়া।
না পণ্ডিত, খড়ের চালের বাড়ি তো—একদিকে চালা অত নামানো যাবে না। দোচালা করতেই হবে। ওপরের বারান্দা অনেক সরু করতে হবে, ঝুলবারান্দা তো নিচের মতো চওড়া করা যাবে না। হাঁটলে-ফিরলে তলতল করবে, দুলবে। বেশি ব্যবহার করতে পারবে না, পণ্ডিত।
ঠিক আছে, আলাদা চালই দাও। নিচের বারান্দার ধারি বেশি উঁচু কোরো না। ফুট দুয়েক করলে, তার বেশি নয়। পাকা হবে মনে রেখো।
জানি না বাপু, পাড়ন দেবে কী দিয়ে? বাঁশ দিয়ে কিন্তু হবে না।
খেপেছ? বাঁশের বংশ থাকবে না এই বাড়িতে। তালগাছ কাঁড়ি দেখেশুনে কিনে আনব গাঁয়ে। করাতিদের খবর দেব, ওরা গাঁয়ে এসে তোমার সামনে গাছ চিরবে। অসার অংশ বাদ দিয়ে স্রেফ কাঁড়ি কাটবে তোমার মনমতো। একটুও অসার আছে বলে মনে হলে ফেলে দেবে।
তাহলে তোমার বাড়িতে বাঁশ ব্যাভার করা যাবে না। চাল তো করোগেট দিয়ে বানাবে না, খুব গরম হবে বাড়ি। তাইলে ঘরের চালের নিচে বাঁশ-কাবারি এসব দিতে হবে।
সে তুমি দিও।
কিন্তু মুদুনি, মানে বাড়ির শিরদাঁড়া কিসের হবে? একদম পাকা বাঁশও তো দেবে না।
না।
তাহলে? মুদুনি কী দিয়ে দেবে? শালকাঠ দিতে পারো।
তা–ই দাও তাহলে। শালকাঠই দাও।
অত লম্বা শালকাঠ কি মিলবে?
মিলবে না?
মনে হয় না।
তাহলে?
এক কাজ করতে পারি।
বলো।
দুটো শালকাঠ দিয়ে মাঝখানে জোড়া দিয়ে দিতে পারি।
আরে সর্বনাশ! জোড়া দেওয়া জায়গাটা ভেঙে পড়বে না তো?
অন্য জায়গা ভাঙতে পারে, ওখানটা নয়।
আচ্ছা, টিন দিচ্ছ না কেন? ঘরের চাল তো দু–তিন বছরেই গোঁজা দিতে হবে। তারপর এক-আধ বছরের মধ্যেই আবার নতুন করে ঘর তুলতে হবে। বারবার খরচ হবে অনেক।
না, হানিফ, খড়ের চালই হবে। তাতে ঘর ঠান্ডা থাকবে।
অত বড় চাল! রাখাই মুশকিল হয়ে পড়বে। ঘরগুলোর চৌহদ্দি দেয়াল অনেক চওড়া করতে হবে। ধরো, দুহাত চওড়া তো হবেই।
হোক না। মাটি তো লাগবেই! এঁটেল মাটি। বলো, কোন মাঠের মাটিতে কাজ মিটবে বেশি?
মানুষমারির মাঠের মাঝখানে যে অশত্থ গাছটা রয়েছে, তার পুবের মাঠের মাটিটা সবচেয়ে ভালো। ভিত দেবো চার হাত চওড়া, তারপর তিন হাত, তারপর জমিন বরাবর হলেই দুহাত চওড়া। পাচির দিয়ে পুরো জায়গাটা তো তুমি ঘিরেছ পণ্ডিত। ওর ভেতরেই কোথাও কাদা তৈরির জন্যে আড়ে-দিঘে ছ’ হাত–বারো হাত একটা জায়গা করো। হাতখানেক বাই দিলেই হবে।
বেনাঘাস কি এখনই মেশাবে?
না, না বেনাঘাসের কথাই নাই এখন।
কাল থেকেই কাজ শুরু হয়ে যাবে হানিফ।
হোক। তোমার বাড়িতে যে বারো মাসের মুনিষ জমিরুদ্দি আছে, ওই ছেলেটা কাজে ফাঁকি দিতে জানে না। ওকেই কাদা দলাইতে লাগিয়ে দাও, সঙ্গে আর এক-আধজন থাকুক। তোমার যে গরিব মামাতো ভাই ওহিদ মল্লিক আছে না, ওকেই লাগাও। ভালো কাজও হবে, সে দুটো পয়সাও তোমার কাছ থেকে পাবে। মাটি এতে গাদা করে রেখে দাও, দরকারমতো কাদা তৈরি করে নেওয়া যাবে।
এর মধ্যে তুমি আর আসবে না?
বাড়ির ছকটা আগে এঁকে নিই। তারপর দড়ি ধরে খুঁটি পুঁতে মাপজোক করার সময় আমাকে আসতে হবে। ভিতের দেয়াল দেবার সময়ও আমাকে থাকতে হবে। ভিত পাঁচ হাত করতে চাইছি, এক হাত উঁচু হলে তিন হাত করব, তারপর জমি বরাবর এলেই দুহাত চওড়া হবে পাচির—আগাগোড়াই তা–ই হবে, এর কম করা যাবে না। ঘরের ভেতরের দেয়াল হবে এক হাত বা দেড় হাত।
তোমার যেমন ইচ্ছে তেমনি করো। এ বাড়ি আমি করাচ্ছি, কবে যে বাস করব, জানি না। কোনোদিনই বাস করব কি না, জানি না। ধরে নাও, বাড়িটা তোমারই।
এই কথাটা বোলো না পণ্ডিত। আমার বড়ো ভয় হয়। কত বাড়ি গাঁয়ে গাঁয়ে খালি পড়ে আছে, দেখো নাই? পুরোনো চাল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, দেয়াল ভেঙে ঘরগুলো খাঁ খাঁ করছে। মনে হয়, গিলে খেতে আসছে। নিজের হাতে তৈরি বাড়ি এখন যেন আমাকেই মরা খুলির চোখের কোটর দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে দেখছে। আশেপাশের বসতি উঠে গেছে, আরও ফাঁকা বাড়ি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। তুমি দেখো নাই পণ্ডিত?
অনেক দেখেছি। গাঁয়ের মাঝখানেই তো এ রকম পোড়ো বাড়ি অনেক রয়েছে। লোকজন চলে গেছে ওই সব বাড়ি ফাঁকা রেখে। সেই দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধের সময়। দিন-দুপুরেও এসব বাড়িতে ঢুকতে ভয় করে। রায়দের কাঁচা–পাকা বাড়িগুলো দেখো না! কুকুর-বেড়ালের আস্তানা। মানুষ না থাকলে তাকে আর বাড়ি বলা কেন?
তাহলে তুমিই বা এখন বাড়ি বানাচ্ছ কী জন্যে? বললে তো, এখন বাস করবে না ওই নতুন বাড়িতে।
এখন না করি, দুদিন পরে করব। দেখো, এই বাড়ি একদিন মানুষজনে গমগম করবে। সারা গাঁয়ের মানুষ বলবে, পণ্ডিতের মতো এমন বাড়ি আর একটাও নাই এদিকে।
ঠিক আছে। তাইলে জোগাড়যন্ত্র করো। বছরখানেকের বেশি লেগে যাবে কিন্তু বাড়ি শেষ করতে।
জমিরুদ্দিকে সঙ্গে নিয়ে পণ্ডিত খানচারেক গরু-মোষের খালি গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন পশ্চিমে তালগাছ কিনতে, মেজ ভাইটাকে পাঠালেন পুবে বাঁশ কিনতে। খবর নিয়েছিলেন, আট ক্রোশ দূরে ভাইগাঁ গাঁয়ে তালগাছ পাওয়া যাবে। ওই এলাকার মাটি এঁটেল মাটির চেয়েও শক্ত। ছোট গাছপালা, ঝোপঝাড়, এমনকি ঘাসও তেমন জন্মায় না। এই রকম মাটি বলেই তালগাছটা খুব হয় এদিকে। বড় বড় দিঘির উঁচু পাড়ে তালগাছের সারি। গাঁয়ে ঢোকার পথটা চওড়া সাদা ধুলোয় ভর্তি, এখন দুপুরবেলায় কেউ কোথাও নেই। কোনো শব্দও নেই। তালগাছের পাতা থেকে যে ঝরঝর, ঝমঝম শব্দ আসছে, তাতে মনে হয়, এ শব্দ চারপাশের ফাঁকা মাঠের গরম নিশ্বাসের আওয়াজ।
এখানে দাঁড়িয়ে পণ্ডিতের পক্ষে শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। মাঠের এই বাতাসে অক্সিজেন নেই। গাঁয়ে ঢুকে গাছপালার নিচে দাঁড়ালে হয়তো একটু আড়াল মিলবে। কিন্তু এ কী রকম শুকনো অথচ সারি সারি মাটির বাড়ি—দু–চারটি করোগেট দেওয়া বড় বাড়ি। দুপুরের রোদে পুড়ছে। বট, অশত্থ, শিরীষ, অর্জুন, শিমুল—এসবের একটি গাছও এখানে নেই। চারদিকে শুধু তালগাছ, গাঁয়ের বাইরে এই সব পেল্লায় প্রায় শুকনো দিঘিগুলোর পাড়ে শুধু তালগাছ, অগুনতি তালগাছ, গাঁয়ের মধ্যেও দু–চারটি ওই তালগাছ। যেতে হবে হরিহরদায়ের বাড়ি। তিনিই খবর দিয়েছেন একটি পোস্টকার্ডে যে যত খুশি তালগাছ তিনি দিতে পারবেন। দামেও কম পড়বে। পণ্ডিত একবার পকেটে হাত দিয়ে নোটের তাড়াগুলো পরখ করে নিলেন। এসব কাদের টাকা, কিসের টাকা? তবে টাকা তো সরাসরি খাওয়া যায় না। হরিহরদা কেন তাদের দুটো ভাত খাওয়াতে যাবেন? বরং দু–একটা তালগাছ মাগনা দিয়ে দিতে পারেন। একটা তালগাছ বেচে সের পাঁচেক চাল মেলাও তো ভার। রেশনে চাল দিচ্ছে না এক ছটাক, গম যত খুশি।
তালগাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে গাঁয়ের পথে নামলেন পণ্ডিত জমিরুদ্দিকে সঙ্গে নিয়ে। দিঘিগুলোর গা ঘেঁষেই গাঁয়ের শুরু—মাটির বাড়ি, খড়ের চাল। দিঘিগুলো হেজে–মজে গিয়েছে। দেখা গেল, মাটির বাড়ির পর বাড়ি মড়া, লোকজন নেই, ঘরগুলোর দেয়াল আধা আধা ভাঙা। ভেতরে ছায়া লুকিয়ে আছে রোদের মাঠের শ্বাসের ভয়ে। সেখানে ঢুকতে ভরসা পেলেন না পণ্ডিত। রাস্তার দুপাশে একটার পর একটা বাড়ি। কী বিরাট এই গ্রাম! কিন্তু প্রায় সবই ফাঁকা। একটা বাড়িতেও মানুষের বসবাসের চিহ্নও নেই। পণ্ডিত টাকাগুলো কোথা থেকে পেয়েছেন? হরিহর সেন যদি বলে, ‘সের দশেক চাল দিয়ে যত ইচ্ছা তালগাছ নিয়ে যাও পণ্ডিত’, তা কি পারবে পণ্ডিত? টাকা সে কোথা থেকে পেয়েছে, তা যেমন বলতে পারবে না, তেমনি টাকার বদলে কিছু চাল দিয়ে দু–চারটে গাছ কেনার কথা বলাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। বরং টাকাগুলোর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াই এখন তার কাছে জরুরি। বাড়ি তৈরি করতে ধান-চাল লাগবে না। আর যা যা লাগবে—মাটি, বেনাঘাস, কাঠ, বাঁশ—এসব এখন দিব্যি কিনতে পাওয়া যায়। হরিহর সেনের বাড়ির দিকে যেতে যেতে পণ্ডিত এসব কথাই ভাবছিলেন। দুনিয়া যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে; যেখানে যুদ্ধ নেই, সেখানেও গনগনা আগুনের তাপ এসে পৌঁছেছে। যা কিছু খাওয়া যায় না, আগুন তা–ও খেতে পারে। দুপাশের বাড়িগুলো এত ফাঁকা এই জন্যেই, যে ভয়ঙ্কর আগুনে যারা এখানে পুড়ছিল, তারা সেই আগুন নেভাবার জন্যেই ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। পণ্ডিত যা কিনতে যাচ্ছে, তা খাওয়া যায় না বলেই সস্তায় পেয়ে যাবে।
গাঁ একেবারে জনশূন্য। ধুলোভরা মূল রাস্তার ওপর একটি মানুষও দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশেই দু–চারটে ফটিকস্বচ্ছ পানিতে টইটম্বুর দিঘি দেখা গেল। তাদের কোনো কোনোটাতে শানবাঁধানো ঘাটও আছে। কিন্তু গাঁয়ের মেয়ে-পুরুষ কেউ নেই। পণ্ডিতের মনের ভেতরটা দমে গেল। তখন একবার তার মনে হলো, মানুষ ছাড়া মানুষ এক মিনিটও টিকবে না। এই ভূতুড়ে গাঁয়ে শুধু রোদ ঝিমঝিম করছে। একজন কাউকে একবার দেখা যাক—দূরে হোক, কাছে হোক—শুধু দেখতে পেলেই হলো। নিজেদের বড় একান্নবর্তী পরিবারে সন্ধ্যেবেলার অন্ধকারে তিনি বাড়ির বাইরের দিকে মাটির নিচু বারান্দায় একা বসে থাকতেন, কেউ এলে বিরক্তি বোধ করতেন। এখন তিনি বুঝতে পারছেন, ভিতরবাড়িতে উত্তর দুয়োরি ঘরে উঁচু বারান্দায় তার ভাই–বোন সবাই বসে আছে বলেই তিনি এখানে একা বসে থাকতেন। মানুষ এইভাবেই মানুষকে চায়। যা–ই হোক, এতক্ষণ পর গাঁয়ের মাঝবরাবর এসে বাঁধানো ঘাটওয়ালা একটা পুকুরে উত্তর-পুব কোণের বাড়ি থেকে একটি ঘোমটা দেওয়া বউমানুষ বাঁধা ঘাটের দিকে আসছে। তার কোমরে কাঁচা সোনার মতো মাজা একটি পেতলের ঘড়া। কী যে শান্তি বোধ করলেন পণ্ডিত! বউটির মুখ দেখারও কোনো দরকার নেই তার। ও যে ঘড়া কাঁখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল, এটাই যথেষ্ট তার কাছে। পুকুরের দিক থেকে হঠাৎ একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এল। কাঠফাটা রোদের দুপুরে এই ঠান্ডা হাওয়াটুকু পণ্ডিতকে এমন বিবশ করে ফেলল কিছুক্ষণের জন্যে যে তিনি ভুলেই গেলেন, কেন এই গাঁয়ে এসেছেন। পুকুরের পশ্চিম পাড়ের ঠিক মাঝখানে বড় অশত্থগাছ রয়েছে একটি। জমিরুদ্দিকে বললেন তিনি, ‘সাইকেলটা নিয়ে তুই এই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নে। আমি পুকুরের পাড়ে ওই গাছের গুঁড়ির উপর কিছুক্ষণ বসে থাকি। নাহয় তুইও সাইকেল নিয়ে আমার সঙ্গে আয়।’
পণ্ডিত কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মনে হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখলেন, সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘দুপুর একদম গড়িয়ে গেছে যে রে, বাড়ি ফিরতে হবে তো দিন থাকতে থাকতে।’
হরিহর সেনের বাড়ি গাঁয়ের পুব পাড়ার শেষে। বাড়ির সামনেই তাদের খামারের বিরাট মাঠ, ঢুকতেই দুপাশে দুটি তালগাছ সিপাইয়ের মতো দুপাশে পাহারা দিচ্ছে যেন। খামারের কোণে বড় তিন-চার ঘরের মাটির বাড়ি। এমনভাবে তৈরি, যেন খামারটা বাড়ির বাইরের উঠোন। মাত্র একটি দরজা খামারের দিকে, বাকি ঘরগুলি পিঠ ফিরিয়ে আছে। ভেতরের আঙিনার দিকে তাদের দরজা। একটি ঘরেরও জানলা নেই বাইরের দিকে। হরিহর সেন বাইরের ঘরের দরজার পাশেই বসে আছেন একটা মাদুরের ওপর। পণ্ডিত তার কাছাকাছি আসতেই তিনি চিনতে পারলেন। খালি একটা মোড়া তার পাশেই ছিল, ‘আসুন পণ্ডিত। আপনি আজ আসবেন, তা তো জানি। কিন্তু এই রোদের মধ্যে এলেন কেমন করে?’
গরজ বড় বালাই সেনমশাই। যুদ্ধের সময়, জাপানি উড়োজাহাজগুলো দিনরাত আকাশে যাচ্ছে–আসছে। বোমাটোমা ফেলতেই পারে। হাতের কাজ ফেলে রাখা উচিত না। না মরা পর্যন্ত মানুষের কর্মের কোনো অন্ত নেই।
গাছ কি নগদ কিনবেন?
নগদ তো বটেই। অন্য উপায় আর তো কিছু নেই।
ক’টা গাছ নেবেন?
গোটা দশেক লাগবে। চার ইঞ্চি সার না হলে নেওয়া যাবে না।
মাপবেন কীভাবে?
হাতুড়ি-বাটালি সঙ্গে আছে। গাছে চার কোনা গর্ত করে মাপা যাবে। বাকিটা আন্দাজ করা যাবে সেন।
দশটা গাছে কত দেবেন পণ্ডিত?
এক শ টাকা নিন।
টাকার তো এখন দাম নেই পণ্ডিত। ধান-চালের হিসেবই এখন সবাই করছে। আপনি সম্মানিত মানুষ, অনেক দূরের গাঁ থেকে এসেছেন। আপনি সর্বমোট এক শ দশ টাকা দেবেন। আপনি গাছ দেখে কাটিয়ে নিন। আমি দেখতেও যাব না।
ঠিক আছে, তা–ই হবে।
পণ্ডিত পকেট থেকে এগারোটা দশ টাকার নোট বের করে সেনের হাতে দিলেন।
রুপোর টাকা পেলেন না বুঝি?
রুপোর টাকা আজকাল বেশ গরমিল হয়েছে। যুদ্ধের সময় সরকারের টাকশাঁলে কাঁচাটাকা খুব বেশি তৈরি হচ্ছে না মনে হয়। কাগুজে নোটই বেশি হচ্ছে। আচ্ছা সেনমশাই, গাঁয়ে মানুষজন কই? গাঁ যে জনশূন্য!
অন্নাভাব পণ্ডিত। কারও ঘরেই খাবার নেই। গত তিন বছর খরা, অতিবৃষ্টি, আগড়া, ধানের মধ্যে চাল নেই। গাঁ ছেড়ে কে কোন দিকে পালিয়েছে!
আমাদের ওদিকে ঠিক এই অবস্থা হয়নি। ধান কিছু কিছু ফলেছিল বটে।
এদিকে আপনি যত ভেতরের দিকে যাবেন, অবস্থা তত খারাপ।
আমি উঠি সেন। গাছগুলো কাটানোর ব্যবস্থা করি।
পণ্ডিত একদৃষ্টে পুবদিকে বিরাট শূন্য মাঠের দিকে চেয়ে রইলেন। গিলে খেতে আসছে যেন উগ্র রোদজ্বলা মাঠ।
যান, ইচ্ছেমতো গাছ কেটে নিয়ে যান।
দিঘিটার নামও সেন-মিত্তির দিঘি। উঁচু চওড়া পাড়ে মাত্র একটি বিশাল অশত্থ, আর বাকি সবই তালগাছ। একসঙ্গে এত তালগাছ পণ্ডিত আর কোথাও দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। স্থিরবুদ্ধির মানুষ হিসেবে তার পরিচয়। অথচ এখন তিনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। বাঁশবনে এসে ডোমও নাকি অনেক সময় কানা হয়ে যায়। কোন বাঁশটা সে নেবে, ভেবে পায় না। পণ্ডিত একবার এ গাছে, একবার পাশের গাছটায়, তারপর দিঘির চারটে পাড়ই ঘুরে এসেও ঠিক করতে পারলেন না, কোন গাছটা কাটাবেন। জমিরকে বললেন, ‘আমি হাঁপিয়ে পড়েছি। হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে তোরাই বরং যা, হাতুড়ি-বাটালি দিয়ে চৌকো গর্ত করে ফিতে দিয়ে মেপে দেখবি, চার কিংবা পাঁচ ইঞ্চি সার হয়েছে, এমন গাছ আমার চাই এগারোটা। যা, ঠিক করে আয়।’
ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এল ওরা। বারো-তেরোটা গাছ ওরা দেখে এসেছে। কোনোটার ভেতরের সার চার-পাঁচ ইঞ্চির কম নয়। পণ্ডিত ওই দারুণ রোদের মধ্যে হেঁটে হেঁটে গাছগুলোকে দেখে এসে বললেন, ‘গুণে গুণে এগারোটা গাছ কাটাবি। মাথা কেটে ফেলে দিবি। একেকটা মোষের গাড়িতে চার-পাঁচটা গাছ বোধ হয় নেওয়া যাবে। গাছ গাড়িতে চাপিয়ে মোটা রশি দিয়ে বাঁধবি। সঙ্গে গাছ কাটার জন্যে এই যে করাতিরা যাচ্ছে, তারাই গাঁয়ের পাকুড়তলায় গাছ চিরবে। হানিফ মিস্ত্রি থাকবে তখন, বুঝলি?’ জমিরুদ্দি বলল, ‘চাচা, সাইকেল নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমি ঠিক গুছিয়েগাছিয়ে গাছ নিয়ে গাঁয়ে যাব।’
সাইকেল করে ঘণ্টা দেড়েক পরে পণ্ডিত বাড়ি ফিরলেন। এখন দুটো খেয়ে নিয়ে তিনি বৈঠকখানার বিছানায় বিশ্রাম নেবেন। আজ থেকে আর ঘরে শোবেন না তিনি। বাগদী বউ আসবে। সারা দিন বড় পরিশ্রম গিয়েছে তার।
গাছ কাটতে যে কজন করাতি গিয়েছিল জমিরুদ্দির সাথে, তারাই দিঘির উত্তর পাড়ের পাকুড়তলায় নামিয়ে নিল সব কটি গাছ। খুব ঠান্ডা ছায়া এখানে। দিনের যেকোনো সময় গাছের পুবদিকে ছায়া থাকবেই। গরমের দিনে এ গাঁয়ের মুসলমান পাড়ার একটি মানুষও বাড়িতে থাকবে না। রোদ পড়ে এলে তবে বাড়ি গিয়ে ভাত খাবে। করাতিদের বাড়ি দেড় ক্রোশ দূরে পশ্চিমে শিমুলে গাঁয়ে ওরা চলে গেল। কালই ওরা দলেবলে করাত-কুড়াল-কোদাল নিয়ে চলে আসবে। গাঁয়েই ডেরা বেঁধে থাকবে চেরাইয়ের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
হানিফ, তুমি সকালেই চলে এসো। করাতিদের সঙ্গে সারা দিন থাকো আর না থাকো, কালকেই সব মাপজোখ বুঝিয়ে দিয়ো। আনতাবড়া চেরাই-টেরাই যেন না করে।
পণ্ডিত, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আমি সব সময় থাকব।
হানিফের দেখতে পাওয়ার কথা নয়, তার চৌদ্দ বছরের পরম সুন্দরী কিশোরী মেয়েটি তখন শুকনো খালের মধ্যে মাথাপিছু দু আনা পয়সার কমে কিছুতেই তার প্যান্ট খুলতে রাজি হচ্ছে না। চার আনা পয়সা দিতে না পারিস, এক পোয়া করে চাল দে। চাল লাফাইছে—তার চেয়ে ছ পয়সা করে নে। কী যে রফা হলো, বোঝা গেল না।
পণ্ডিত, দু-চার সের চাল দিতে পারো? টাকার আমার কোনো দরকার নেই।
এটা যে পারা যাবে না হানিফ। বরং দিনপ্রতি পাওনা দু পয়সা বেশি নাও।
টাকা নিয়ে কী করব পণ্ডিত?
আমারও যে উপায় নেই।
পণ্ডিতের মনে পড়ল, কাল রাতে বাগদী বউও চাল চেয়েছিল। দিতে পারেননি। সে জানিয়ে দিয়েছিল, খালি পেটে সে আর আসতে পারবে না। অন্য কিছু পেটে এলে সে ওষুধ খেতে পারে, খিদের কোনো ওষুধ নেই। মনে হয়, আমারও আর বেশি দিন তোকে লাগবে না।
হানিফ মিস্ত্রির ফরসা মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল। সে শুধু বলল, ‘মাপজোখ তো একরকম হয়েই গেছে। কাল কিংবা পরশু দেয়াল আরম্ভ। দু-তিনটে মুনিশ নেবে।’
সে আমি লোক লাগিয়ে দিয়েছি।
কী করব, বলো তো পণ্ডিত? খেটেছি, মজুরি নিয়েছি, খুদ-কুঁড়ো যা–ই হোক, খেয়ে জীবন কাটিয়েছি এত কাল। সংসার তো খুবই ছোট আমার। এইবার যে মনে হচ্ছে, উপোস করা ছাড়া আর কোনো উপয় নেই।
সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ চলছে হানিফ, যুদ্ধ চলছে। গোটা দেশ ভরে গিয়েছে বিদেশি সোলজারে। আগে তাদের সব দরকার পূরণ করে, তারপর আমাদের। আমাদের দিকে মিলিটারি কম; কাটোয়া, বর্ধমান, বোলপুরের দিকে যাও। সেখানে দেখতে পাবে, ওই হারামজাদা খাকি, লাল বাঁদরগুলোর দাপট।
বাবার কালে শুনিনি পণ্ডিত, রেশন আবার কী কথা? চাল তো বিক্রি করে না এক ছটাকও। গম দেবে, নুন দেবে একটু-আধটু, চিনি দেবে আর পরিবারপ্রতি দুটো মিলের মোটা কোরা শাড়ি। সম্বছরে দুটি। বাড়িতে মা, বউ, বেটি ন্যাংটো থাকলেও মিলবে না বাজারে একখানা কাপড়। গম পিষে ঝাড়াই-বাছাই করে রুটি তৈরি করে। সন্ধ্যেবেলা কোথাও একটু আলো নাই। হারিকেন-লম্ফ এখন কেউ জ্বালাতে পারে না। এক ফোঁটা কেরোসিন নেই কারও বাড়িতে। সরষের তেল পুড়িয়ে পিদিমই বা কজন জ্বালাতে পারে? এখন বাড়ি করছ তুমি পণ্ডিত! লোকে খারাপ বলবে না?
চাল-ডাল দিয়ে তো বাড়ি করছি না হানিফ। মাটি-কাদা-বাঁশ-খড়-তালকাঁড়ির কড়িবরগা দিয়ে বাড়ি হবে। এসব এখন একটু সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে।
তা ঠিক বলেছ, পণ্ডিত। মানুষ এখনো মরতে শুরু করেনি বটে, তবে মড়ক লাগবেই, দেখো তুমি। হয়তো আমিই পরিবার নিয়ে... সবাই মারা পড়ব। তবু কাজকম্ম যা হোক, করি। দেখি, কদিন এভাবে যায়!
তুমি কাজ শুরু করে দাও, হানিফ। দু-চার সের চাল তোমাকে জোগাড় করে দিতে পারি কি না, দেখি। বাড়িটায় কিন্তু ফাঁক-ফাঁকি একটুও দিতে চাই না, মাগগি গণ্ডির বাজার বলে।
‘মাটির বাড়ি: যত দিন চন্দ্র সূর্য’ নামে অপ্রকাশিত গল্পটি হাসান আজিজুল হক লিখতে শুরু করেছিলেন ২০১৮ সালে, লিখেছিলেনও অনেক দূর—তাঁর ছোট ছোট হাতের লেখায় ১১ পৃষ্ঠা।
এই গল্পে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় অভাবপীড়িত বাংলা অঞ্চলের আলো–হাওয়া। সেই প্রেক্ষাপটে লেখা গল্পটিতে পাওয়া যাবে একটি মাটির বাড়ি নির্মাণের কাহিনি। তবে লেখকের ইচ্ছা ছিল, এটি কেবল মাটির বাড়ি তৈরির গল্প হবে না, বরং বাড়ি নির্মাণের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এখানে স্পষ্ট হবে রাঢ়বঙ্গের সমাজচিত্র ও সামাজিক শ্রেণিকাঠামোর বিন্যাস।
কিন্তু গল্পটি তিনি পুরোপুরি শেষ করে যেতে পারেননি। তারপরও এখানে একধরনের সমাপ্তির আবহ আছে। আর মূলত সংলাপের আশ্রয়ে রচিত এই গল্পে হাসান আজিজুল হকের শিল্পিতাও ষোলো আনা টের পাওয়া যায়।
নিজের হাতে লেখা হাসান আজিজুল হকের শেষ রচনা এটি, শেষ গল্পও বটে। এরপর তিনি অনুলেখকের সাহায্যে অন্য নানান লেখা লিখলেও গল্প আর লেখেননি। গল্পটি পাওয়া গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সাজ্জাদ বকুলের সৌজন্যে।