Skip to content

Latest commit

 

History

History
18 lines (12 loc) · 11.2 KB

লুঙ্গির-ভেতর-১০০-দিন-আবুল-মনসুর.md

File metadata and controls

18 lines (12 loc) · 11.2 KB


লুঙ্গির ভেতর ১০০ দিন

আবুল মনসুর



লুঙ্গির মতো আরামদায়ক পরিধেয় হয় না। আমাদের কালে, অর্থাৎ ষাটের দশকের গোড়ায়, কৈশোর পার হতে না হতে লুঙ্গি না পরে লম্বা লম্বা ঠ্যাং বের করে হাফপ্যান্ট পরা বেয়াদবি বলে গণ্য হতো। সেই থেকে, মানে প্রায় ৬০ বছর, বাসায় লুঙ্গি পরে আসছি। আমি বলি, হয়তো আরও কেউ কেউ বলেছেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলমানের দুটি অবদান ইতিহাস লিখে রাখেনি। এক. লুঙ্গি, দুই. বদনা। লুঙ্গির ব্যবহার এখন প্রায় ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠেছে, বদনা কেন সেটি পারল না, ভেবে অবাক হই। ভারতে পড়তে গিয়ে বদনাহীন দুবছর কত বিড়ম্বনা যে সহ্য করতে হয়েছে—হোস্টেলে ওভালটিনের ফুটো হয়ে যাওয়া টিন আর গুজরাটের গ্রামে বন্ধুর বাড়ি রাতযাপন শেষে মাঠেঘাটে প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়ে লোটার পানি ঝপাং করে নিঃশেষ করে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়ার গল্প আসর মাতাতে কাজে লাগে বৈকি।

লুঙ্গিতে অবশ্য জাতিভেদ প্রবল। শহুরে মধ্যবিত্তের মানসম্মানবোধ খুব ধারালো, লুঙ্গিকে ঘরে তুললেও বাইরে তার ব্যবহার শিষ্টাচারবিরোধী। বাইরের জন্য ট্রাউজার, পাজামা রাখা আছে। আমাদের চট্টগ্রামে অবশ্য স্থানীয় উচ্চবিত্ত সমাজেও লুঙ্গি পরার চল ছিল, সে অবশ্য অতি দামি সুতি বা রেশমের লুঙ্গি। সওদাগর নামে যাদের খানিকটা নিচু চোখে দেখা হতো, তারা সর্বক্ষণ এ লুঙ্গিই পরত, এখন জাতে ওঠার জন্য আর পরে না। বার্মায়, অধুনা মিয়ানমারে গিয়ে দেখে আরাম লাগল, সবাই লুঙ্গি পরে—ছোট-বড়, বড়লোক-ছোটলোক, পুরুষ-নারী—সবাই। পুরুষেরা অবশ্য শার্টের ওপর লুঙ্গিটা পরে, তাদের ভাষায় লুঞ্জি। দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায়ও লুঙ্গি বেশ সর্বজনীন। পাকিস্তান, নেপাল হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা দেশ পর্যন্ত লুঙ্গি আপনাকে বিস্তৃত করতে পেরেছে নিজ যোগ্যতায়। আমাদের উচ্চবিত্ত সমাজে অবশ্য লুঙ্গির চল তেমন ছিল না, তাঁদের ছিল পাজামা, স্লিপিং স্যুট বা ড্রেসিং গাউন, সিনেমায় নায়িকার বড়লোক বাবাকে যেমনটি দেখানো হতো আরকি। এখনো নাটক-সিনেমায় মধ্যবিত্ত নায়ক লুঙ্গি পরে আছে, এমনটি অল্পই দেখা যায়। নিম্নবিত্তের অবশ্য বাঁধাধরা চেহারাই ছিল নিচের দিকে লুঙ্গি, উর্ধ্বাংশে খালি গা আর গামছা। ঊর্ধ্বাঙ্গে এখন শার্ট বা গেঞ্জি উঠলেও আর নিচে জিনস বা পায়জামার দেখা মিললেও লুঙ্গির প্রতাপ কমেনি দেখে স্বস্তি পাই। অবশ্য টলোমলো মধ্যবিত্তের উচ্চবিত্তের মতো হওয়ার প্রয়াস সব সময়ের মতো বহাল আছে। আমার চেয়ে যার বয়স বিশ বছর কম, সে মধ্যবিত্ত পুরুষ এখন লুঙ্গি পরে না। প্রথমে পাজামা, পরে সাহস করে হাফপ্যান্ট ধরে ফেলেছে।

লুঙ্গির গুণকীর্তন করে শেষ করা যাবে না। আমাদের মতো গরম ও আর্দ্র দেশে এমন হাওয়া চলাচলের উপযোগী পরিধেয় আর কী হতে পারে। ভালো সুতির লুঙ্গির ভেতর শরীরটা ঢুকিয়ে শুলে গরমের দিনে ঘুমটা আরামের হয়। তবে লুঙ্গিতে গিঁট্টু মারার কায়দাটা ভালো জানতে হয়, না হলে কালেভদ্রে ইজ্জত নিয়ে টানাটানিতে পড়ার ভয় আছে। আমি এমন গিঁট্টু মারতে পারি, যা টেনেও কেউ খুলতে পারবে না, বোতাম-বক্লস আঁটা প্যান্টের চেয়েও জোরদার। তবে লুঙ্গি যেখানে সবাইকে টেক্কা দেয়, সেটি হলো উন্মুক্ত স্থানে বদলাবার সুবিধা, লুঙ্গি থেকে লুঙ্গিতে ট্রান্সফার শুধু নয়, হাফপ্যান্ট-ট্রাউজার-পায়জামা সবই এর আওতার মধ্যে।

আর ভণিতা না করে আসল কথায় আসা যাক। ২৩ মার্চ থেকে ১০০ দিন হয়ে গেল টানা লুঙ্গির ভেতরে আছি। এটি রেকর্ড কি না জানি না, তবে এই ১০০ দিন অ্যাপার্টমেন্টের চৌকাঠের ওপারে পা দিইনি। আমার এ সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের কারণ আমার হৃদয়ের ভঙ্গুর দশা, পেসমেকার নামক যন্ত্রের ঠেকনা দিয়ে একে চালু রাখা আছে। বয়সও বসে নেই, বড় ডাক্তার পই পই করে বলে দিয়েছেন, আমার কোনোমতেই বাইরের সংস্পর্শ চলবে না, কোভিড-১৯ খবর পেলেই হলো, আমার খবর হয়ে যাবে। গিন্নি ভেতর-বাহির সব সামলে পরিশ্রান্ত-কাহিল হয়ে আমাকে কোভিড অথবা অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখছেন। তাঁর সার্বক্ষণিক সাহচর্য যেমন দুর্লভ অভিজ্ঞতার, লুঙ্গি মহাশয়ের সার্বক্ষণিক বেষ্টনও একই রকম, দুটিই ভালোবাসার বন্ধন। এমন অবস্থা অতীতে হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। অবশ্য ভাইরাসটির এ হামলা তো ইতিহাসেরই একটি বিরলতম ঘটনা, এর সাক্ষী হতে পারা সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য, সেটি অবশ্য এখনো ফয়সালা বাকি আছে।

প্রেমের ওভারডোজ ওষুধের মতোই বিপজ্জনক হতে পারে। গিন্নির বেলায় এ বিষয়ে আলোচনা না করাই নিরাপদ, লুঙ্গির কথাটি ভেবে দেখা যায়। এর ভেতরে আবদ্ধ থাকতে থাকতে একটু হাঁসফাঁস তো লাগছেই, বেচারা শার্ট-প্যান্ট-পাঞ্জাবিদের মলিন চেহারা দেখতে দেখতে একটু মায়াও লাগছে। যখন সময় আসবে এদের পরতে পারব তো, গায়ের মধ্যে কুটুস-কাটুস কামড়াবে না তো, সেই সৈয়দ মুজতবা আলীর নতুন গেঞ্জিপরা পণ্ডিতমশাইয়ের মতো? বড়ই আদরের লুঙ্গিটির গায়ে হাত বোলাই, কোনো মায়াবিনীর মতো ভোলাচ্ছে না তো, এত বেশি বেশি প্রেম কি ভালো? একটু সন্দেহের চোখে তাকাই লুঙ্গিটির দিকে, মাঝেমধ্যে তোমার আলিঙ্গন থেকে ছুটে শার্ট-প্যান্ট পাঞ্জাবির মধ্যে সেঁধিয়ে ঘুরেটুরে এলে ক্ষতি কী? ভালোবাসায় মাঝেমধ্যে বিরতি স্বাস্থ্যকর, সেই একটা কথা আছে না—বেশি ভালো ভালো নয়, সে রকম আরকি। লুঙ্গির প্রতি আমার গভীর প্রেম ব্যক্ত করেও সে রকম একটি স্বাধীন দিনের আশায় থাকি। সেই দিনটি আসবে বলে শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতার মতো প্রতীক্ষায় থাকি।