দড়িটা শক্ত কি না, তা ভালো করে টেনেটুনে দেখে নেয় ফারুক। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে যেভাবে ফাঁসির দড়ি পরখ করে নেয় জল্লাদ; সেভাবেই পরখ করছিল ফারুকও। তবে মরার জন্য না, বাঁচার জন্য।
ফারুখের দড়ি পরখ করা দেখে রফিক দারোয়ান তাড়া দেয় তাকে।
: আরে, এত দেখনের কী আছে! নতুন দড়ি কিন্যা আনছি, আমি কি তোর খারাপ চাই? তুই দড়ি ছিঁড়্যা পড়লে আমারই তো সমস্যা। কত দিন ধইরা ত্যাল মারতাছি তোরে! তোর মোটে মতই হয় না! আরে যাবি তো সেফটি ট্যাংক পরিষ্কার করতে। পাতালে তো আর যাবি না!
‘পাতাল’ শুনে মুহূর্তে ফারুকের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। এক অজানা ভয় কাঁকড়াবিছের মতো কামড়ে ধরে তাকে। তাই ঝাঁজের সঙ্গে বলে ওঠে, পাতালের আর বাকি কী আছে! পাতালেই তো যাইতাছি। পাতাল যদি না হয় তয় তুমিও লও আমার লগে, হেইডা তো যাবা না!
: কী যে কস, আমার কি তোর মতো দম আছে রে! তুই হইলি জোয়ান মর্দ। কই তুই, আর কই আমি!
রফিক দারোয়ান চতুরতার সঙ্গে ফারুককে তেল মারতে থাকে। কোনোমতে ফারুক যেন বেঁকে না বসে। এই মাল হাত ফসকে বের হয়ে গেলে আবার তাকে কতজনকে কতভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে! ম্যানেজার সাব তো অ্যালান করে দিছে, ‘এইবার সেফটি ট্যাংক পরিষ্কার করাতে না পারলে তোমার চাকরি থাকবে না রফিক! টুলে বসে ঝিমানো ছাড়া তো কোনো কাজ করতে দেখি না।’ রফিক দারোয়ান একটু প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলে, অত চেতিস ক্যান, তর তাড়া আছে দেইখাই তো কইছি।
: যামু যামু, জরুরতের উপরে তো কোনো কথা খাটে না। তার আগে একটা সিগ্রেট দ্যাও, দুইটা টান দিয়া নামি।
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফারুক আয়েশ করে মাটিতে বসে একটু দুলতে দুলতে বলে, জানো রফিক ভাই, তুমি লোকটা ধুরন্ধর! যেই দেখলা আমি একটা বিপদে পড়ছি, আমার আর কোনো উপায় নাই, তহনই আমারে এই দোজখে পাডানোর ব্যবস্তা করলা!
: আরে, এ দেহি কাউরে উপকার করলেও দোষ! তোর বউ হাসপাতালে, তুই কোনোখান থাইকা টাকা জোগাড় করতে পারোস নাই। হেই জন্য না আমি এই ব্যবস্তা করলাম। আমার কাছে ট্যাকা থাকলে কি তরে দিতাম না!
ফারুক সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার ভঙ্গিতে ফুঁ দিয়ে রফিক দারোয়ানের কথাটা উড়িয়ে দিতে দিতে বলে, তুমি দিতা টাকা! দড়ি টেস্ করার দাও না, আর টাকা! দড়ি ছিঁড়্যা পইড়া যদি হাত-পা ভাঙ্গি, তহন দেখব কে?
: পড়বি না রে পাগলা।
: অনেকেই তো শুনি সেফটি ট্যাংকে নাইমা মইরা যায়। আমি যদি মরি, আর যদি উঠতে না পারি! আমার বউয়ের কী হইব! আমার সন্তানের? অগো কেডা দেখব?
: আরে মহা জ্বালা তো! তোর কিছু হইব না কইলাম তো! এইটা তো কয়েক মাস পরপরই পরিষ্কার করা হয়। এইটাতে কোনো সমস্যা নাই।
ফারুকের সন্দেহ যায় না। সে বারবার একই কথা বলে যায়, সমস্যা নাই তো! তুমি ঠিক কইতাছ?
: ভুল ক্যান কমু, আমি কি তোর খারাপ চাই?
: এই দুনিয়ায় কাউরে আর বিশ্বাস হয় না জানো, ডাক্তারও কইছিল, রমিসার কোনো সমস্যা নাই। নরমাল ডেলিভারি হইবে। কিন্তু আইজ ক্যান কইল সিজার করন লাগবে?
: আমি ক্যামনে কমু বাপ। আইজ-কাইল তো সবাইরে শুনি সিজার করন লাগে। কম বয়স, বেশি বয়স কোনো বাছবিচার নাই।
: ডাক্তাররা এত টাকা দিয়া কী করে?
: আমি কী জানি! উদাস ভঙ্গিতে জবাব দেয় রফিক দারোয়ান।
: রমিসা বাঁচব তো?
: ধুর ব্যাটা, বাচ্চা হইতে গিয়া কেউ মরে নাকি? দ্যাশে কোটি কোটি বাচ্চা।
: তয় আমি বাঁচমু তো?
: এই সব ভ্যাজালের কথা না কইয়া তুই নাম তো!
ফারুকের ভেতর থেকে আপছে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে।
তোমারে কইয়া কী লাভ রফিক ভাই, আইজকা আমার দ্যাশ–গ্যারামে থাকলে কি এই অবস্থা হইত! কেউ না কেউ সাহাইয্য করতই।
: সেইখানে থাকতে পারলি না ক্যান? গরিবের অত মাথা গরম থাকলে চলে? অহন বোঝ ঠ্যালা!
: গরিব বইল্যা কি সব অন্যায় মাইন্যা নিতে হইব? আমার ন্যায্য পাওনা মেম্বার দেয় নাই। রাগের মাথায় তারে এক ঘুষি মারছি। তাই বইল্যা সে অ্যাটেম্পট টু মার্ডার মামলা দিব! আর পুলিশ সেই মামলা নিব! কী দ্যাশে আছি ভাবো একবার! আরে, আমি তো একটা ঘুষিই মারছি শুধু! মেজাজটা এত খিঁচড়াইয়া গেছিল, কী কমু! রোজার সময় রিলিফ আইছে, রমিসা রোজা রাইখ্যা রৌদের মধ্যে দিনভর বইসা থাকল মেম্বারের উঠানে। মেম্বার তার লোকেদের রিলিফ দিল, রমিসারে দিল না। আমি মেম্বরের বিরোধী ক্যান্ডিডেটরে সাপোর্ট দিছিলাম। তাই সে আমাগো রিলিফ দিব না। এইডা কোনো কতা! রিলিফ কি তোর বাপের! আমরা ভোটার না? আমাগোরে দিবি না ক্যান! দিল তো না-ই, উল্টা মামলা দিয়া দ্যাশছাড়া করল।
: তুই মারতে গেলি ক্যান? এই রকম ঘটনা তো আকছার ঘটে। ওরা তো ওই রকমই, যারা অগো বিরোধিতা করে, হ্যাগো ওরা রিলিফ দেয় না। জন্মনিবন্ধন করতে গেলে সই দেয় না। এমনকি আমাগো এক ম্যাম্বর আছে, হ্যায় তো সবার কাছ থাইক্যা জন্মনিবন্ধনে সই করা বাবদ পাঁচ শ কইরা ট্যাকা নেয়। ট্যাকা না দিলে সই নাই। কই, কেউ তো কিছু কয় না! কওয়ার সাহসও দেখায় না। দ্যাশছাড়া হইতে কার অত শখ আছে ক! তুই কোন বুদ্ধিতে মারামারি করতে গেলি! বয়স কম তো, রক্ত গরম তগোর।
: রক্ত গরমের কতা না, রমিসার কষ্ট আমি সইহ্য করতে পারি নাই। আমি নিজে গেলে, আমারে না দিলে কিছুই হইত না। কিন্তু রমিসার কী দোষ? তারে ক্যান দিল না! রোজামুখে সারা দিন বসাইয়া রাখল, এইটা কোনো ইনসাফ হইল!
: রমিসারে তুই অনেক ভালোবাসোস, না?
: জানো রফিক ভাই, অরে পরথম যেদিন আমি দেখছি, ভাবছি ও মানুষ না, পরি! আমাগো নদীর পাড়ে শ্মশানঘাট, তার পাশে লাশকাটা ঘর। নির্জন সুনসান জায়গা। আমরা কয় দোস্তে মিলা ওইখানে যাইতাম গামের নেশা করতে। গামে আগুন ধরাইছি, ঘন নীল রঙের ধোঁয়া উঠছে, হ্যার মইধ্যে দেহি এক পরি খাড়াইয়া আছে। ভাবলাম নেশার ঘোর। নাইলে লাশকাটা ঘরের পাশে মাইয়া মানুষ কী করে!
পরে বুঝলাম যে না, লাশকাটা ঘরের ঠিক পিছনে আইলের মতো একটা সরু মাটির রাস্তা, তার মাথায় বড় বড় দুইটা কাঁঠালগাছ, সেই গাছের আড়ালে কয়টা ছোট ছোট ঘর। ওইখানে থাকে ইরফান ক্যানভাসার। বাসস্ট্যান্ডে ক্যানভাস কইরা নানা বটিকা ব্যাচে, রমিসা হ্যার মাইয়া। আমার তো তারে মনে ধরল, কিন্তু ক্যানভাসার আমার লগে মাইয়া দিব না। আমি নেশা করি, ভাদাইম্যা। আমারে কে মাইয়া দিতে চায়!
আমি যে সত্যি নেশাখোর না, তালে পইড়া টানি, ভাদাইম্যাও না, কাম পাইলে করি। এউডা তারে কে বুঝাইব! শ্যাষে অনেক কাঠখড় পুড়াইলাম বুঝলা; ম্যালা হুজ্জোতের পর তারে ঘরে আনলাম!
কিন্তু আইজ তার মান রাখতে পারলাম কই? আইজ আমি দ্যাশ–গ্যারামছাড়া, ঘরছাড়া। রমিসা তার এক আত্মীয়রে ধইরা গার্মেন্টসে কাজ নিল। আমি তো তারে খাওয়াইতেও পারি না, কইতে গেলে সে-ই আমারে খাওয়ায়! মাথার উপরে ছাদের জোগাড় নাই, আইজ এই ঘরে তো ভাড়া বাকি পাড়লে কাইল রাস্তায়। ট্যাপপোনার মতো ভাসি। যেইখানেই যাই, সেইখানেই আমরা মরি! মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো, রফিক ভাই?
রফিক আর আগ্রহ দেখায় না জানার। সে জানে, যত সে জানতে চাইবে, তত এই ব্যাটার প্যাঁচাল লম্বা হতে থাকবে। এখন এর লম্বা প্যাঁচালে সঙ্গ দিতে থাকলে বেলা ফুরাইয়া যাবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না! তাই কথা ঘোরাতে সে বলল, শোন ভাই ফারুক, আগে কামডা শ্যাষ কর। সমস্যা তোর যত, আমাগোও কি তার চাইতে কম কিছু রে! ও কথা কইয়া আর লাভ কী!
: কথাডা তাইলে তুমি শুনবা না?
: শুনমু কইলাম তো! আগে কাজটা কর! বউ যে হাসপাতালে শোয়াইয়া রাইখ্যা আসছছ। ভুইল্যা গেলি!
সিগারেটটা আঙুলের টোকায় একটু দূরে ছুড়ে দিয়ে দড়িটা ধরে বিমর্ষ ভঙ্গিতে ট্যাংকের ভেতরে নামতে নামতে ফারুক বলে, নাহ, ভুলি নাই। ভুলি কেমনে!
ভেতরে নামার সঙ্গে সঙ্গে এক তীব্র গন্ধের ঝাঁজ ফারুকের নাকে এসে লাগে। ভেতরটা অন্ধকার। ওপর থেকে আলগা তারের সঙ্গে একটা এক শ পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে ভেতরের অন্ধকার দূর হয়নি। ট্যাংকের যত নিচের দিকে নামে, ততই ফারুকের মনে হতে থাকে যেন চারদিকের অন্ধকার এসে তাকে জাপটে ধরেছে। মুহূর্তে যেন অসুরের শক্তি নিয়ে কোনো দানব তাকে চেপে ধরেছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। ডান দিকের বুকের পাঁজর যেন বাঁ দিকে ঢুকে যাচ্ছে। ফারুক প্রাণপণে চিৎকার করার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড খরায় চৌচির হয়ে যাওয়া মাটির মতো তার গলায়ও যেন অসংখ্য ফাটল ধরেছে। সে চিৎকার করছে, কিন্তু ফাটা গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছে না।
ফারুক ওই মুহূর্তে ভাবতে চেষ্টা করে, সে কি মরে গেছে? সে কি পৌঁছে গেছে ইয়া নফসির ময়দানে! যেখানে কেউ কারও না। কারও চিৎকার কারও কানে পৌঁছায় না যেখানে, সেখানে কি চলে গেছে সে! সে একটানা ডেকেই চলেছে, ডেকেই চলেছে...কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। ফারুক ভাবে, বেঁচে থাকুক বা মৃত—তাদের ডাকে কেউ কখনো সাড়া দেয় না।
এমন এক হতাশায় ডুবে যেতে যেতে ফারুকের মনে হতে লাগল, সে যেন ভাসছে। তার পিঠের ওপরে যেন দুটি ডানা গজিয়ে গেছে। সেই ডানায় ভর করে সে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে ওই মৃত্যুকূপ থেকে। এই যাত্রা বেঁচে গেলে, রমিসাকে নিয়ে সে পালাবে এখান থেকে। সে তার বিশাল ডানা মেলে উড়তে থাকে হাসপাতালের দিকে। রমিসার কি একটা কন্যাসন্তান হয়েছে! ফারুকের খুব শখ, তার একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে। সে জনে, জনে মিষ্টি বিলাবে।
তার খুব তাড়া এখন। খুব দ্রুত তাকে পৌঁছাতে হবে রমিসার কাছে, তার মেয়ের কাছে। কিন্তু ডানা দুটো কেন যেন ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। সে যেন দিকহারা এক ক্লান্ত পরিযায়ী পাখি!