এটা ছিল তেমন একটা দিন যেদিন আমি সবকিছু জিতে যাব। যেদিন আমার কানের পাশ দিয়ে একটা গুলি চলে যাবে এবং আমার চুলের ডগাটিও পুড়বে না। আমার পায়ের তলা থেকে ছাদ খসে যাবে কিন্তু আমি দেখব আমার পিঠে রয়েছে আসলে অলৌকিক এক ডানা। দিনটা আমার। এই দিনে আমি জিতে যাব আমার নারীটিকে; নারীর মতোই মোহন স্বপ্নটিকে এবং হারিয়ে দেব তাদের, যাদের বিজয়ী জীবন দেখে দেখে আমার চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যাদের উন্নতির খবর পৌঁছে গেছে শহরের তাবৎ চিলেকোঠায়।
বন্ধুর বুকে আমি ছুরি বসিয়েছি। ছুরিটা অদৃশ্য। কিন্তু দৃশ্যমান ছুরির চেয়েও সেটা শাণিত। যেকোনো ছুরির চাইতেও সেটা সমৃদ্ধ। সমৃদ্ধিই তো সফলতা।
সাফল্য এখন আমার দুই হাতে। দুটো ব্যাগ। ভেতরে থরে থরে সাজানো টাকা। নগদ। কড়কড়ে। ঘ্রাণওয়ালা। শিহাব বলেছিল, দুই কোটি!
শিহাব আমার বন্ধু বটে। অন্তত শিহাব তো তা-ই মনে করত। একই মহল্লায় বেড়ে উঠেছিলাম আমরা। ও জন্মেছিল সোনার চামচ মুখে নিয়ে। আমার ভাগে স্টিলেরও জোটেনি। তাতে কি! সেই জন্মের তিরিশ বছর পর শিহাবের সব আমার হয়ে যাবে। নারীটি তো হয়েছে আগেই!
আমেরিকা থেকে ফিরে শিহাব আমাকে খুঁজেছিল। আমি তখন একটা কোচিং স্কুলে ক্লাস নিই। বাংলা ক্লাস। বোঝাই ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ শব্দের অর্থ কী! ছেলেগুলো বাংলাদেশের হলেও বাংলা বোঝে না। তারা কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রধান শিক্ষক—যিনি একই সঙ্গে চামার ও পিআরসমৃদ্ধ মানুষ, আমাকে জর্দা খেতে খেতে হেদায়েত দেয়, ‘আপনে মাস্টার ভালো। কিন্তু ভালো মাস্টারের দরকার আমাদের নাই। আমাদের দরকার ধুরন্ধর পাবলিক, যে আরও ছাত্র আনতে পারবে। আপনে সামনের সপ্তাহে চাইরটা পোলা-মাইয়া ভর্তি করাইবেন এইখানে!’
সামনের সপ্তাহে আর ছাত্র ভর্তি করাতে হয়নি আমাকে। কারণ, তার আগেই শিহাবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছিল আমার। রাস্তায়।
আমি ফুটপাতে। চিরকাল যেমন ছিলাম।
শিহাব গাড়িতে। চিরকাল যেমন সে ছিল।
দুজনের দুটো কফি হয় এরপর। আমেরিকার গল্প শোনায় সে এবং আমার যে বলার মতো কোনো গল্প নেই, সেটাও নিমেষে বুঝে নেয়। তার ঠিক দুই দিন পর শিহাব ডেকে চাকরি দেয় আমাকে। তারই অফিসে। তারই সেক্রেটারি। বলা ভালো, তার চামচা। শিহাব বলে, বন্ধুর কাজে বন্ধুই তো আসে!
আমি বুঝি শিহাব আমাকে করুণা করেছে। করুণাপ্রার্থী হিসেবে নিজেকে দেখতে ভালো লাগে না। একটা সপ্তাহও যেত না, চাকরিটা ছাড়তাম আমি। বন্ধু শিহাবের ঐশ্বর্যের মালিগিরি করার চাইতে ঢের ভালো চামার হেডমাস্টারের চামচামি করা। পরেরটায় অন্তত সমবয়সীর সীমাহীন সুখ দেখার কষ্ট সইতে হয় না।
কিন্তু চাকরিটা ছাড়া হয় না। আর ঠিক এখানেই চলে আসে লিপির গল্প।
ওহ্, লিপি!
কে না ভালোবাসত তাকে! আমাদের ক্লাসের সবাই। এমনকি কলেজের শিক্ষকেরাও। আমাদের শাসিয়ে লিপির দিকে মধু ঢেলে দিত একেকটা ভাঁড়। শুধু কেমিস্ট্রির টিচার ফারজানা মিস আমাকে বলেছিল, ‘শোনো রায়হান, তুমি লিপির থেকে দূরে থাকবা। ও কিন্তু আগুন!’
মিস জানত না আমি কীটবিশেষ। আগুন যেদিকে, সেদিকেই তো যাব। ঝাঁপ দেব। জ্বলেপুড়ে মরে যাব। কিন্তু না পোড়া হলো, না মরা। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে লিপিরা গায়েব। এত সুন্দর নিখুঁত গোল একটা মুখ, মুখটা হঠাৎই শহর থেকে নাই! মনে হলো পুরো শহরটা একটা বছর ঝিম মেরে রইল। শীতে শীত এল না, বর্ষায় বৃষ্টিও। আকাশ ঠোঁট উল্টে থাকল দিনের পর দিন। নদী শুকিয়ে গেল—দুই পাড় এক হয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
অথচ সেই লিপিকেও আমি ভুলে যাই। তাতে কি? শিহাব ভোলেনি। আমেরিকা থেকে ফিরে খুঁজে বের করে নিয়েছে ঠিক ঠিক। শালা! সব চায় তার, স...ব!
লিপি এখন আরও গোল, আরও সুন্দর। চুলে রং আছে তার, মুখে প্রসাধন। বিত্তের ঘ্রাণ আছে উন্মুক্ত মাংসসমূহে। শিহাবের বৈভব যদি বিবমিষা জাগায় তো লিপির উপস্থিতি আমাকে এখনো তাড়িত করে। লিপি এখনো হাসে, আগের মতোই। কখনো কখনো আমার কাঁধে হাত রেখে দেয় আলগোছে। সুযোগ পেলে বলে ফেলে সেই কথাটি, ‘আমি ভাবছিলাম আমাদের মধ্যে সবচে বেশি শাইন করবা তুমি!’
আমিও তো তা-ই ভাবতাম। ভাবতাম পৃথিবীটাকে খোয়াবের বাবলে ভরে রেখে দেব নিজস্ব কৌটায়। যখন খুশি তার ভেতর থেকে বের করব সুখের রেশম। কীট হয়ে ঝাঁপাব এক শ আগুন। সমুদ্র হয়ে ডোবাব তাবৎ ইলিশ—যাপনে উষ্ণতায় মিটবে জীবনের শীত।
কিন্তু পারিনি। পারি যে নি, সেটা এত দিন নিজেকেও বলিনি। এত দিন পর এসে সহজ আয়নাটা যখন লিপির তুলে দিল মুখের সামনে, লিপিকে তখন, আমি কীট হতে চাই বলেই হয়তো, জাপটে ধরি—আক্রোশে অথবা প্রেমে; অথবা উভয় কারণেই। হিসহিসিয়ে বলি, ‘তুমি থাকলে পারতাম!’
জানতাম এরপর শিহাবের ঝড় আসবে। আসুক। তবে লিপিকে আঁকড়ে ধরার যে এতকালের অবদমন, তা তো মিটে গেল! তাকে বুকের সঙ্গে লেপ্টাতে আর কোনো দিন কোনো কল্পনার আশ্রয়ে যেতে হবে না আমাকে।
ফিরেই যাচ্ছিলাম এরপর। জীবন যাদের ব্যর্থ করে দেয়, তারা এর চেয়ে বেশি পারে না। তখন, কী অদ্ভুত, লিপিই বলে ওঠে, ‘তাইলে রাখো না কেন?’
যে লিপিকে একটা শহর ভালোবাসত, সেই লিপি যে আমাকেই ভালোবেসেছিল—এতটা অবিশ্বাস্য ছিল এ খবর যে আমি তখন কাঁপছিলাম থরোথরো। আমার দিনগুলো তাহলে ব্যর্থ হয়নি! পুড়ে যাওয়ার রাতগুলো তাহলে মরে যায়নি! লিপি আমারই ছিল—এমনকি, চাইলে, এখনো, আমারই হবে!
লিপিই যে এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে! একটা লতার মতো, আমাকেই।
অস্তিত্ব বিলীন করা আমাদের প্রেমের পর্যায়টা ছিল প্লাবনের মতো। যেন ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে দামামা। একটা অসুস্থ যুদ্ধের ভেতর পৃথিবীর শেষ গোলাপ নিয়ে আমরা দুজন মেতেছি জীবনের উল্লাসে। এ রকম চোরাবালি সুখের ভেতর লিপি বলে নিয়তির মতো অমোঘ কথাটা, ‘শিহাব জানলে মেরে ফেলবে আমাদের!’
আমি বলি, ‘তাকে বইলো আমাদের কবর যেন হয় পাশাপাশি।’
লিপি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় আমাকে, ‘ম্যান্দা পুরুষ আমার খুবই না-পছন্দ!’
‘তাইলে কী করবা বলো, পালাবা আমার সহিত?’
কী করতে হবে, আমাকে তা লিপিই বলে দেয়।
ব্যবসার জন্য কবে দুই কোটি টাকা ওঠাতে হচ্ছে শিহাবকে, কবে সে সেগুলো রাখছে বাসার লকারে; আর ঠিক কবে, কখন গেলে শিহাবকে বাসায় কেবলই পাওয়া যাচ্ছে একা— তখন, এমনকি, লিপিও থাকবে না; তখন, এমনকি ড্রাইভারও থাকবে না; তখন, এমনকি গার্ডও থাকবে না। সব ব্যবস্থা করে লিপি অপেক্ষা করবে দূরে। কেবলই আমার জন্য!
আমি কীট। আমি তো আগুনে ঝাঁপ দেবই।
অবেলায় আমাকে দেখে শিহাব জিজ্ঞাসু হয়। কিন্তু সেসবের ধার দিয়েও আমি যাই না। ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর ওপর। শিহাবের কিছুটা সময় লাগে পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে, ড্রয়ার হাতড়ায় সে। পিস্তলটা সেখানে নেই; বরং ওর পিস্তলটা তখন আমার হাতে। গত অভিসারেই লিপি সেটা আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘কাজে লাগাইও।’
কাজে লাগে যন্ত্রটা।
তারই গুলি, তারই বুকে, দুটো ছিদ্র করে। পরপর। কিন্তু আমার মনে হয় না আমি তাকে গুলি করেছি। মনে হয় তার পিঠে বসিয়ে দিয়েছি অতিকায় এক ছুরি। অদৃশ্য সেই ছুরির ধারের কাছে পৃথিবীর সব বিশ্বাস ফিকে হয়ে আসে। শিহাব রক্তে গোঙায়, আমি টাকায়। হত্যা-বিত্ত-নারী...আমার জীবনের একমাত্র সাফল্য। একসঙ্গে। এক দিনে। আজকে আমার মাথা ঠেকে গেছে আকাশে। আজকে আমি হয়ে উঠেছি তা-ই, যা আমি হতে চেয়েছিলাম। আমি আর ব্যর্থ কেউ নই।
হাতিরঝিলের দ্বিতীয় বাঁকটা পেরোতেই কাঙ্ক্ষিত গাড়িটার দেখা পেয়ে যাই। ভেতরে অপেক্ষমাণ লিপি। আমার একান্ত লিপি, যাকে একটা শহর ভালোবেসেছিল, যে শুধু আমাকেই ভালোবাসে। আমার হাতভর্তি টাকা। আমরা হয়তো নতুন একটা শহর কিনে নেব। লিপি চাইলে আমরা নতুন দুটো জীবনও কিনে নিতে পারি।
ভেতরটা অন্ধকার। গাড়িতে ঢুকতেই লিপির কণ্ঠ, ‘শেষ হয়েছে?’
আমি হাসি। বলি, ‘উমহু। সবে তো শুরু। শিহাবের শেষ। আমাদের শুরু।’
তখনই শুনি অন্য একটা কণ্ঠ। আবছায়ায় বিশেষ দেখে উঠতে পারি না তাকে। দেখি একটা ইউনিফর্ম। চাপাকণ্ঠ। বলে, ‘সব শেষ হয়নি, লিপি। এবার হবে।’
লিপি খিলখিল হেসে জড়িয়ে ধরে লোকটাকে। লোকটাও। এদিকে আমার চোখের মধ্যে বাড়ানো একটা নল। কালো পিস্তল—শীতল মাজল। লোকটা বলে, ‘শিহাব হত্যার দায় নিয়ে আপনি মারা যাচ্ছেন, তৈরি হন।’
একমুহূর্তে যেন বুঝে উঠতে পারি বিষয়টা। বুঝতে পারি লিপির নিখুঁত পরিকল্পনাটা। কিন্তু সে নিয়ে কথা বলার সুযোগই তৈরি হয় না।
লিপি শুধু ফিসফিস করে বলে, ‘শোনো, একটু আস্তে গুলি করো, প্লিজ! ও আমার পুরোনো কীট!’