ঘরগুলো আয়তাকার উঠোনটি ঘিরে। বাপ-চাচারা চার ভাই, তাদের চারটি ঘর। কোনো উঠোন কি এমন একটি সময়ে পুরো ফাঁকা থাকতে পারে! আরিফ মোবাইলে সময় দেখে। ঠিক ৩টা ১১। ঘরগুলোর দরজা ভেড়ানো, উঠোনটি পুরো সুনসান। একটু আগেও কত কোলাহল ছিল, মাতম ছিল। কেউ মারা গেলে গ্রামের লোকেরা মৃত মানুষের সঙ্গে তার নানা স্মৃতি মনে করে আর সুর করে কাঁদে। সেই সুরের কান্না কার ইঙ্গিতে যেন থেমে গেছে। শোকেরও যেন ক্লান্তি আছে। তারও বিশ্রাম লাগে।
চারটি ঘরের একটির বারান্দায় আরিফ। আয়তাকার উঠোনটিকে সামনে নিয়ে সে বসে আছে। তার ঠিক মুখোমুখি একটি ঘর, বাঁয়ে একটি ঘর ও ডানে একটি ঘর। উঠোনটি যে একেবারে জনশূন্য এবং কোথাও কারও সাড়াশব্দ নেই, সেটা সে হঠাৎই আবিষ্কার করে। ঘরগুলোর মধ্যে বাঁয়েরটি পুরোনো চৌচালা ঘর। মেঝেটি মাটির। সুন্দর করে লেপা মাটির মেঝের বাইরের অংশ ও ওঠার সিঁড়িটির দিকে আরিফ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বাকি তিনটি ঘরের সংস্কার হয়েছে, কোনোটিই আগের মতো নেই। এই তিনটি ঘর অবশ্য বছরজুড়ে তালা দেওয়াই থাকে। এই ঘরগুলোর লোকজন ঢাকায় থাকেন। মাঝেমধ্যে তাঁরা এখানে আসেন—শীতের সময়ে কয়েক দফা বা নানা উপলক্ষে। তখন এগুলোর তালা খোলা হয়, যেমন আজ খোলা হয়েছে।
জুলাই মাসের ১ তারিখ। আষাঢ়ের মাঝামাঝি। কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি নেই। আকাশে তেমন মেঘও দেখা যাচ্ছে না। আষাঢ় মাস হিসেবে বলা যায় পরিষ্কার আকাশ। ঘরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু গাছ। সব গাছ আরিফ চেনে না। বেল, জাম্বুরা, আম আর নারকেল—এই কটিই সে চিনতে পারে। একটি বেশ বড় গাছ, পাতাগুলো চিরল চিরল। হালকা বাতাসে পাতাগুলো নড়ছে। আরিফ বারান্দায় বসে আকাশের দিকে, ওই গাছটির দিকে তাকায়। গরমটা ভ্যাপসা ধরনের, তবে সে খুব একটা টের পায় না।
বাঁয়ের পুরোনো যে ঘরটিতে বছরজুড়ে লোকজন থাকে, সেই ঘরটির টিনের চালার নিচে বেড়া ঘেঁষে একটি কবুতরের ঘর আছে। দুপুরের এই সময়ে কয়েকটি কবুতর খোপগুলো থেকে মুখ বের আছে। তারা হু হু হু হু ধরনের শব্দ করে যাচ্ছে। টানা একঘেয়ে এমন শব্দে সম্ভবত আরিফের চোখ বুজে আসে। আর ক্লান্তি তো আছেই। গত রাতে তার ঘুমানোর সুযোগ ছিল না। সকালে ঘণ্টা চারেকের জার্নি করে এখানে আসা। এর সঙ্গে দায়িত্বগুলো ঠিকভাবে পালনের চিন্তা। সবকিছু শেষে যে কারোরই শরীর ছেড়ে দেওয়ার কথা। শূন্য উঠোনটি তাকে স্বস্তি দেয়।
পায়ে কিসের কামড়ে আরিফের ঘুম বা তন্দ্রা কেটে যায়। দেখে একটি কালো পিঁপড়া। লাল পিঁপড়ার কামড়ে ব্যথা বেশি বলেই আরিফ জেনে এসেছে। কিন্তু সে এখন কালো পিঁপড়ার কামড়ের ব্যথাও টের পেল। আরিফের মনে পড়ে গেল, মাকে কবরে নামানোর সময় তাকে নিচে নামতে হয়েছিল। ভোররাতে খবর দেওয়ার পর গ্রামের লোকজন কবর খোঁড়া শুরু করেছিল। আরিফরা আসার আগেই সেই কাজ শেষ হয়েছিল। অনেক যত্নে মাকে কবরে শোয়ানোর পর আরিফ যখন উঠে আসছিল, তখন কবরে এই কালো পিঁপড়াগুলোকেই সে দেখেছিল। মনের মধ্যে তখন মোচড় দিয়ে উঠেছিল, এত যত্ন করে মাকে এই পিঁপড়ার মধ্যে রেখে যেতে হবে! কিন্তু নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, মাটিতে তো পিঁপড়া থাকবেই। সেটা তার আবাস। মৃত মানুষের জন্য আবাস তৈরি করতে গিয়ে হয়তো তাদের আবাস বিপন্ন হয়েছে। আর সময়টা বর্ষার, এ সময় পিঁপড়া এমনিতেও অনেক দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বলা হয়, খাবার নিয়ে পিঁপড়া যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়, তখন বর্ষা নামে।
আরিফ তার পায়ের পিঁপড়াটিকে না মেরে সরিয়ে দেয়। সে জানে, পিঁপড়ারা দল বেঁধে লাইন ধরে চলে। চলার পথে তারা কী যে তরল পদার্থ ছড়িয়ে যায়, যা অন্যদের পথ দেখায়। সে আশপাশে অন্য কোনো পিঁপড়া দেখতে পায় না। এটি তবে কোথা থেকে এল? আরিফ তার চোখে পানি টের পায়।
যে বারান্দায় আরিফ বসে আছে, তার পেছনের ঘরের রুম দুটোতে তার বোনেরা আছে। নীরবতা ভেঙে তাদের কথাবার্তাগুলো আবার স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, কান্নার শব্দও শোনা যাচ্ছে। ঘরগুলোর দরজা খুলছে, উঠোনটিতেও কেউ কেউ আসতে শুরু করেছে। শোকের সম্ভবত বিশ্রাম শেষ হয়েছে। দীর্ঘ ক্লান্তি কেটেছে। সবাই আবার শোকে সক্রিয় হতে শুরু করেছে।
আরিফ এখন কী করবে বুঝতে পারে না।