বিপদে পড়লে মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আলতাফ সাহেবের মাথায়ও আকাশ ভেঙে পড়ল, তবে মহাকাশ স্টেশন মিরসহ। কারণ, দুই মাস ধরে তার বেতন বন্ধ। তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। করোনার কারণে অফিসের সবার বেতন বন্ধ , প্রথম মাসে অর্ধেক বন্ধ হয়েছিল, পরের মাসে পুরোই বন্ধ। ব্যাংকে যা দু-এক পয়সা ছিল, তা-ও শেষের দিকে। বাসায় বাজার-সদাই কিচ্ছু নেই...।
তারপরও সেদিন দুপুরে খেতে বসে চমকালেন। স্ত্রী হঠাৎ গলা চড়িয়ে বললেন, ‘খেতে বসেছ? আজ ভালো কিছু রাঁধতে পারিনি—মোরগ পোলাও, গরুর রেজালা, সবজি আর পুডিং...।’ আলতাফ সাহেব হতভম্ব হয়ে দেখেন, টেবিলে কচুর লতি আর গতকালের বাসি ভাত ছাড়া কিছু নেই! এর মানে কী? তিনি স্ত্রীর দিকে তাকালেন। স্ত্রী চোখ টিপে একটা ভ্রুভঙ্গি করলেন। তখনই আলতাফ সাহেবের মাথায় পুরো ব্যাপারটা খেলে গেল। পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার সঙ্গে একটা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা আছে। কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। ওপাশের ফ্ল্যাট থেকে তখন শোনা যাচ্ছে, ‘ওগো, খেতে আসো, গরম-গরম খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাবে...আজ বেশি কিছু করতে পারিনি—মুরগির কোরমা, পোলাও, রুই মাছ ভাজা, আর ডিম চপ, পায়েসটা চুলায় আছে। তুমি খেতে খেতে হয়ে যাবে...’
আলতাফ সাহেবের জানামতে, পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোকেরও বেতন বন্ধ। ওই করোনা দুর্যোগের কারণেই।
তো আলতাফ সাহেব এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটা ধ্রুব সত্য টের পেলেন। সেটা হচ্ছে, মিথ্যার একটা অন্য রকম শক্তি আছে। একটা আরামও আছে...আনন্দ তো আছেই এবং তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিলেন, আচ্ছা, কিছুদিন মিথ্যা বললে কেমন হয়, সত্য না বলে? সত্য বলার আসলে অনেক বিপদ। মনে আছে, তার জীবনের প্রথম চাকরির সময় (সেখানে বেতনও বেশি ছিল) অফিসের একটা দুর্নীতি নিয়ে এক সাংবাদিককে সত্য বলেছিলেন বলে পরদিনই তার চাকরি চলে গিয়েছিল।
কাজেই আলতাফ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ থেকেই তিনি মিথ্যা বলবেন। অন্তত এই করোনাকালটা মিথ্যা দিয়ে পার করলে কেমন হয়? এবং তার প্রথম মিথ্যা দিবসে তিনি মাস্ক ছাড়া বের হলেন। পথে পরিচিত দু-তিনজন অবাক হয়ে বললেন, ‘একি আলতাফ ভাই, আপনি মাস্ক ছাড়া বাইরে?’
: মাস্ক পরতে হবে কেন?
: কী বলছেন, করোনাভাইরাস...
: ওহ্আমার এলাকায় এসব নেই।
বলে হাঁটা দিলেন।
মিথ্যা বলে বলে আলতাফ সাহেবের বেশ কাটল দিনটা। দু-একটা নমুনা দেওয়া যাক। এক বন্ধু তার কাছে মিনমিন করে জানতে চেয়েছিল, ‘তোর টাকাপয়সার কী অবস্থা? আমার অফিস তো বেতন দিচ্ছে না।’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘সে কি, আমার অফিস তো উল্টো তিন মাসের বেতন অ্যাডভান্স দিয়েছে, তোর কি টাকাপয়সার দরকার? তোর বিকাশ নম্বরটা এসএমএস কর তাহলে!’
আরেক বন্ধু পথে তাকে দেখে তার মোটরসাইকেলে লিফট দিতে চাইল। তিনি অম্লান বদনে বললেন, তার গাড়ি চাকায় হাওয়া দিতে গেছে, তিনি গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন।
: গাড়ি কিনেছিস নাকি?
: হ্যাঁ। ওহ্, তোকে বলাই হয়নি। অফিস থেকে সিনিয়র অফিসারদের সবাইকে ‘করোনা লোন’ দিল। তাই ভাবলাম টাকাটা কাজে লাগাই। একটা টয়োটা এক্সিও কিনে ফেললাম, পনেরো শ সিসি! বাজেটে গাড়ির দাম বাড়বে, তাই আগেই...।
বন্ধু শুকনা মুখে বলল, ‘ওহ্’
তো যাহোক, সারাটা দিন মিথ্যা বলে হৃষ্ট চিত্তে বাসায় ফিরলেন আলতাফ সাহেব এবং এভাবেই চলতে লাগল তার দৈনন্দিন মিথ্যাচার। একটা মিথ্যা ঢাকতে দশটা মিথ্যা বলতে হয়। মোট এগারোটা মিথ্যা আসলে এগারোটা গল্পই, হয়তো মিথ্যা গল্প! তাতে কী, গল্প তো। মানুষ সব সময় গল্পই খোঁজে!
: তুমি নাকি সারা দিন মিথ্যা বলে বেড়াও!
একদিন স্ত্রী চেপে ধরলেন স্বামীকে।
: কে বলেছে? মিথ্যা কথা!
আলতাফ সাহেব চমকে গেলেন। তিনি এটা কী বললেন, এ তো একটা অন্য রকম প্যারাডক্স হয়ে গেল মনে হচ্ছে!
তবে খুব শিগগির একদিন রাতে খুক খুক কাশি শুরু হলো তার। সঙ্গে হালকা জ্বর। ভোরবেলায় গলা জ্বলতে লাগল, কেমন চুলকানির মতো। স্ত্রী আতঙ্কিত হয়ে তাকালেন তার দিকে!
: তোমাকে তো মনে হচ্ছে করোনাভাইরাসে ধরেছে!
: আরে না, সামান্য সর্দি-কাশি। করোনা-ফরোনা কিছু না...ওই সব কোভিড নাইনটিন-ফাইটিন এসব ভুয়া কথা; পশ্চিমা বিশ্বের ভ্যাকসিন বেচার একটা ধান্দা, বুঝলে? এক কাপ গরম-গরম আদা-চা দাও দেখি...
আলতাফ সাহেব ঠিক করেছেন, তিনি মিথ্যাচার চালিয়ে যাবেন। কি বাইরে, কি ঘরে। স্ত্রী চা নিয়ে ফিরে এসে দেখেন, আলতাফ সাহেবের হেঁচকির মতো হচ্ছে। আগের চেয়ে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে শঙ্কামাখা গলায় বললেন,
: তোমার শ্বাসকষ্ট কষ্ট হচ্ছে!
: আরে না, ওই অ্যাজমার টানটা হঠাৎ...
কম্পিত হাতে তিনি চায়ের কাপটা নিলেন এবং খেয়াল করলেন, স্ত্রী মাস্ক পরে আছেন ঘরের ভেতরে।
: কী গো, মাস্ক পরে আছ কেন?
স্ত্রী কিছু বললেন না, তবে তার চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক। আলতাফ সাহেব টের পেলেন, তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মিথ্যা চলছে, চলবে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘কোভিড নাইনটিন-ফাইটিন বলে আসলে কিছু নেই, তুমি মাস্ক পরে মুখ ঢেকেছ আসলে আমার মতো মিথ্যাবাদী একটা লোককে বিয়ে করেছ বলে লজ্জায়, তাই না...?’
আলতাফ সাহেবের স্ত্রী কী মনে করে মাস্কটা খুলে ফেলে তার স্বামীর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ‘সত্যি করে বলো তো তুমি কি করোনা পজিটিভ?’