Skip to content

Latest commit

 

History

History
100 lines (53 loc) · 18.5 KB

একদিন-মিষ্টিতে-বিকেলে-মো.-সাইফুল্লাহ.md

File metadata and controls

100 lines (53 loc) · 18.5 KB


একদিন মিষ্টিতে বিকেলে

মো. সাইফুল্লাহ



সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ঝুমমিষ্টি। মিষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, থামার আর নাম নেই। জবুথবু হয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা ফলের দোকানের সামনে।

দোকান বলতে লক্কড়ঝক্কড় ভ্যানগাড়ি, ওপরে কোনোরকম একটা শতছিন্ন তেরপল টানানো। ভেবেছিলাম তেরপলের নিচে খানিকটা আশ্রয় পাওয়া যাবে। উল্টো ফলের দোকানদারই আমার ভাঙাচোরা ছাতাটার নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি তাঁর আস্ত দোকানটাকে আমার ছাতার নিচে আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

‘‌‌‌উস্তাদ, একটু কিনারে আইসা খাড়াইবেন নাকি?’ বলেই তিনি প্রায় টেনে আমাকে এক পাশে নিয়ে গেলেন। ‘এইবার ছাতাটা একটু কাইত কইরা ধরেন… আরেকটু… অ্যাএএ, এইবার ঠিক আছে!’

বেটার আধপচা আম আর আপেলগুলো বাঁচাতে গিয়ে আমার মাথা থেকে ছাতা প্রায় সরে গেছে। থপথপ করে বড় বড় মিষ্টি এসে পড়ছে শরীরের বাঁ পাশে। বাঁ কাঁধ, বাঁ হাত, বাঁ পা—সব মিষ্টির রসে মাখামাখি। বাঁ পায়ের জুতার ভেতরও রসের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। কিন্তু কিছু করার নেই।

দোকানদারকে হালকা ঠেলা দিয়ে আমি ছাতার নিচে আরও একটু জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। বেটা টাইট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছাতাটা আমরা দুজন মিলে ধরে রেখেছি ঠিকই। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে।

‘আইজকা আর থামব না।’ বলে দোকানদার ছাতাটা আরও একটু নিজের দিকে টেনে নিলেন।

অসহায়ের মতো ছাতা থেকে মাথাটা একটুখানি বের করে আমি ওপরে তাকালাম। কথা সত্য। আকাশে ঘন দুধের ঘনঘটা। কোথাও সাদা। কোথাও দুধ ঘন হতে হতে হলুদ হয়ে এসেছে। আজকে মিষ্টি পড়া সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না।

আমি বেরিয়েছি একটা জরুরি কাজে। মর্ষার সঙ্গে দেখা করব। ওকে একটা সুখবর দেওয়ার আছে—আমার চাকরি হয়েছে। সিটি করাপ্টোরেশনে সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি। বেতন খুব বেশি না। ২২ হাজার ৬৭৫ টাকা। মন্দ কী!

মর্ষা বিকেল চারটা থেকে অপেক্ষা করছে। ঘড়িতে এখন দেখাচ্ছে সাড়ে পাঁচটা। তবে আমি টের পাচ্ছি, বারোটা বেজে গেছে। মর্ষা নিশ্চয়ই রেগে আগুন হয়ে আছে। শুরুর দিকে একটু পরপর ফোন করছিল। এখন তা-ও করছে না।

আমি আবার মনে মনে হিসাব করার চেষ্টা করলাম। পকেটে আছে ৪৩২ টাকা। এখন যদি মর্ষার বাসায় যেতে একটা রিকশা নিই, ৪০ টাকা খরচ হয়ে যাবে। হাতে থাকবে ৩৯২ টাকা।

মর্ষাকে নিয়ে রিকশায় করে যাব রবীন্দ্রসরোবরে। সেখানে ১০০ টাকার ফুচকা কিনে মোটামুটি ১ ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। রবীন্দ্রসরোবরে যাওয়া–আসার ভাড়া পড়বে কমপক্ষে ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে ২৪০। বাকি থাকল ১৯২।

মুশকিল হলো, সুখবর দিতে খালি হাতে যাওয়া যাবে না। অন্তত এক কেজি বৃষ্টি তো নিতেই হবে। বৃষ্টির কেজি কম করে হলেও ২২০ টাকা। এখন রিকশা নিলে বৃষ্টি কেনা হবে না। ওদিকে দেরিও হয়ে যাচ্ছে। যে জোরে মিষ্টি পড়ছে, ছাতা হাতে রওনা দিলে পথেই পুরো মাখো মাখো হয়ে যাব।

ধ্যাত, ভুল হলো। সকালে চমচম পড়ছিল। তখনই বের হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আগেভাগেই নাহয় মর্ষার বাসার আশপাশে গিয়ে ঘুরঘুর করতাম। এখন ইয়া বড় বড় রসগোল্লা পড়তে শুরু করেছে। রসে টইটম্বুর একেকটা মিষ্টি। লোকজনের ঘাড়ে-মাথায় থপ করে পড়েই লেপ্টে যাচ্ছে, বিশ্রী অবস্থা।

এই দুর্দশার মধ্যেও আমার হঠাৎ ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। স্কুলে পড়ার সময় মিষ্টির দিনে কী যে আনন্দ হতো! আমাদের স্কুলের বিশাল মাঠটা মিষ্টিতে ঢাকা পড়ে যেত। সকাল থেকে মিষ্টির মধ্যে ছোটাছুটি করে ফুটবল খেলে আমাদের একেকজনের চেহারা হতো দেখার মতো। বিকেলের দিকে মা জোর করে, কানে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতেন। চড়-থাপ্পড় খেয়ে, গোসল করে, সন্ধ্যায় ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পড়তে বসতাম।

বাবা অবশ্য কখনোই কিছু বলতেন না।

আমার বাবা ছিলেন এলাকার নামকরা বয়রা। সুজন বয়রা—বললেই লোকে একনামে চিনত। বাবা সত্যিই নামকরা ছিলেন কি না, সে ব্যাপারে অবশ্য আমি নিশ্চিত নই। ছোটবেলা থেকে শুধু শুনেই এসেছি, বৃষ্টি বানানোতে একসময় বাবার খুব নাম–যশ ছিল। দূরদূরান্ত থেকে লোকে বাবার হাতের বৃষ্টি খেতে আসত। এখন তো সব প্যাকেটে প্যাকেটে মেঘ পাওয়া যায়। রেডিমেড। কিন্তু বাবা নাকি নিজ হাতে মেঘ বানাতেন। সারা রাত ধরে মেঘ বানিয়ে, সকালে নিজ হাতে মেঘের সঙ্গে মেঘ ঘষে বৃষ্টি বানাতেন।

এর সবই শোনা কথা। একটু বড় হওয়ার পর আমরা আর বাড়িতে বৃষ্টি দেখিনি। শুধু অভাব দেখেছি। এতই যখন সুখ্যাতি ছিল, তাহলে কেন বাবার বৃষ্টির ব্যবসাটা বন্ধ হয়ে গেল, জানি না। কখনো জানতেও চাইনি।

ছোটবেলা থেকে বাবার ওপর আমার খুব রাগ। লোকটাকে পছন্দ করতাম না কখনোই। অপছন্দের সব মানুষের সঙ্গেই আমি বাবার মিল খুঁজে পাই। কলেজের শরিফুজ্জামান স্যার থেকে শুরু করে মেসের বাড়িওয়ালা—সব খিটখিটে মেজাজের, অকর্মণ্য কিংবা বিরক্তিকর লোককেই কেন যেন বাবার মতো লাগে। এখন যেমন এই ফলের দোকানদার বেটাকে বাবা বাবা লাগছে। একটু আগপর্যন্ত যা-ও আমার মাথার ওপর খানিকটা ছাতা ছিল, এখন তিনি পুরোটাই নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছেন। আমি দাঁড়িয়ে থপ থপ মিষ্টিতে গা মাখাচ্ছি। মাথায় এখনো কোনো মিষ্টি পড়েনি, এই যা একটু রক্ষা। শ্যাম্পু করা চুলে মিষ্টি পড়লে বড় বিরক্ত লাগে।

নাহ্, আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে আমি ছুটলাম। পেছন থেকে ফলের দোকানদার মনে হয় ভদ্রতা করেই বললেন, ‘উস্তাদ, ছাতাটা?’

‘রেখে দেন। আপনি তো আমার বাবার মতো।’

শুনেই কেন যেন লোকটার চেহারা বিষাদে ছেয়ে গেল। বেটা আমার বাবাকে চেনে নাকি?

মর্ষাদের বাড়ির কাছে, একটা গলি আগেই বৃষ্টির বড় দোকান। বৃষ্টিবিতান। ঢাকায় ওদের বেশ কয়েকটা শাখা আছে। রিকশা থেকে নেমে, কোনোমতে মাথা বাঁচিয়ে আমি বৃষ্টিবিতানে ঢুকে পড়লাম।

দোকানের ভেতর বড় করে লেখা, ‘খাঁটি মেঘের বৃষ্টি। কেজি ২৪০ টাকা।’

যাহ্। এর মধ্যে বৃষ্টির দামও ২০ টাকা বেড়ে গেল! নাকি মিষ্টির দিন দেখে বৃষ্টির দাম বেড়েছে?

অত তর্কে যাওয়ার সময় নেই। এমনিতেই বড় একটা রসগোল্লা পড়েছে ঘাড়ে। জামার ভেতর চুইয়ে চুইয়ে রস পড়ছে। টিস্যু দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে বললাম, ‘এক কেজি বৃষ্টি দিন তো।’ নিয়েই নিই, যা থাকে কপালে। ফুচকা নাহয় দুই প্লেটের বদলে এক প্লেট নেব।

দোকানদার বয়স্ক লোক। বেশ সময় নিয়ে বোতলে বৃষ্টি ভরলেন। এদিকে আমার সময় চলে যাচ্ছে।

‘ভাই, জলদি করেন না!’ তাড়া দিলাম।

বৃষ্টির বোতল হাতে নিয়ে টাকা বাড়িয়ে দিয়েছি। দোকানদার হেসে বললেন, ‘লাগবে না।’

‘লাগবে না মানে? কেন?’

‘তুমি সুজন বয়রার ছেলে না? দেইখাই চিনসি।’

‘আপনি আমার বাবাকে চেনেন?’

‘চিনব না ক্যান? খুব চিনি। তোমার বাপ আর আমি মিইল্লা বৃষ্টির ব্যবসা করতাম। আহা, কী দিন আছিল! তখন এত টাকাপয়সা ছিল না, কিন্তু দশ গেরামে নামডাক ছিল। তোমার বাপের জুয়ার দোষটাই ডুবাইল।’

‘বাবা জুয়া খেলত!’

‘খুব খেলত। আমার কাছ থেইকা প্রচুর টাকা ধার করসে। ফেরত দিতে পারে নাই। পরে কী আর করা। মেঘ মেশিনটা নিয়া আমি ঢাকা আইসা পড়সি।’

‘মেঘ মেশিন মানে? বাবা না নিজ হাতে মেঘ বানাত?’

‘আরে যাহ্! সব ভুয়া কথা। মেশিন দিয়া মেঘ বানাইতে সময় লাগত ঘণ্টা দেড়েক। বাকি সারা রাত তোমার বাপ মদ খাইত। সকালে তোমার মায়ে দেইখা ভাবত, রাতভর কাম কইরা লোকটার চোখ গোল হইয়া আছে। হা হা হা! কী দিন আছিল!’

আমি কী করব, কী বলব, বুঝে পাই না। আরও একবার টাকাটা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। দোকানদার হেসে বলেন, ‘আরে রাখো রাখো। তুমি সুজনের পোলা। টাকা ক্যামনে নিই?’

বাবাকে আজীবন অপছন্দ করে এসেছি। বাবা জুয়া খেলত, মদ খেত, এমনকি নিজ হাতে মেঘ বানানোর মিথ্যা গল্প বলত—এত সব জেনেও কেবল ২৪০ টাকা বাঁচল বলে আচমকা লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল।

‘আপনার ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখি? বাবার সঙ্গে দেখা হলে বলব।’ বলতে বলতে পকেটে হাত দিয়েই চমকে উঠলাম। তাই তো বলি, এতক্ষণ মর্ষার ফোন আসছে না কেন! ফোন তো পকেটে নেই! সব কটি পকেট তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললাম। নাহ্, নেই!

শেষবার পকেট থেকে ফোন বের করেছিলাম ফলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। দোকানদার কেন আমার সঙ্গে অত ঘেঁষাঘেঁষি করছিলেন, হঠাৎ করেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

আমি লোকটা গরিব হতে পারি। কিন্তু ফোনটা দাম দিয়ে কেনা। এতক্ষণ এত ঝক্কিতেও অতটা ঘাবড়ে যাইনি। কিন্তু ফোন হারিয়ে এবার সত্যিই মনটা বেজায় খারাপ হলো।

এখন কি ফোন খুঁজতে যাব? নাকি মর্ষার কাছে? ভাবতে ভাবতে মর্ষার বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি। অমনি দেখি সেই ফলের দোকানদার বেটা হেঁটে আসছেন। আমার দিকেই! এ তো দুধ না চাইতে মিষ্টি!

আমি মুখ খোলার আগে তিনিই মুখ খুললেন, ‘উস্তাদ, আপনি তো ফোন ফালায় আসছিলেন। কী সব লক–ফক মারসেন ফোনে, খুলতেই তো পারি না। ভাগ্যিস আপার ফোনটা আসছিল। যান যান, ফোন আপার কাছে দিয়া আসছি।’

এই ঝুমমিষ্টিতে বেচারা এত দূর হেঁটে এসেছেন স্রেফ একটা ফোন ফেরত দিতে! অথচ লোকটাকে নিয়ে কী যা তা ভাবছিলাম!

তবে আমি যে বারবারই মানুষ চিনতে ভুল করি, তার আরও একটা প্রমাণ পাওয়া তখনো বাকি।

সেদিনের পর মর্ষাকে আমি আর খুঁজে পাইনি। মর্ষা এবং আমার ফোন—দুটোই হারিয়ে গিয়েছিল চিরতরে।