আমি যশোর ক্যান্টনমেন্টের সিএমএইচ শাখার ফ্যামিলি উইংয়ের সুইপার নূরজাহান। এখনো আমি বেঁচে আছি । এখনো আমি একভাবে বলে চলেছি ১৯৭১ এ ঘটে যাওয়া সেই নৃশংস হত্যকাণ্ডের কথা। যত দিন বেঁচে থাকব, এ কথাগুলো আমি একভাবে বলে যাব। আল্লা আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষকে এ কথা বলে যাবার দায়িত্ব দিয়েছেন। আর তাতে করে আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ।
হ্যাঁ, ১৯৭১-এ আমি ছিলাম বিবাহিতা ও দুই বাচ্চার মা। আমার স্বামীও ছিলেন সুইপার। আমরা সেই একাত্তরের মার্চ মাসে যশোর ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করতাম। আমরা সুখী দম্পতি ছিলাম। আমাদের খাওয়াদাওয়া ও বাসস্থানের সমস্যা ছিল না। বছর পাঁচেকের মতো যখন আমাদের চাকরির বয়স, তখন শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।
ছেলেবেলায় আমার মা নাম রেখেছিলেন নূরজাহান। আমি জানিনে আমার মা কোত্থেকে এই নাম শুনে আমার নাম রেখেছিলেন। আমি চাকরি করার সময় সিএমএইচের একজন ডাক্তার স্যারের মুখে সেই অনেক দিন আগে শুনেছিলাম, নূরজাহান নাকি খুব নামকরা একজন ম্যাডাম ছিলেন। একজন বাদশাহর বেগম ছিলেন। এসব বহুবছর আগের কথা। তখন আমাদের দেশটা নাকি মুসলমান বাদশাহরা চালাতেন।
আমি যখন একদিন যশোর সিএমএইচের ডাক্তার মেজর স্যারের অফিসঘর পরিষ্কার করছিলাম, তখন হাসতে হাসতে স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী মেয়ে?আমি বললাম, নূরজাহান।আর মেজর স্যার একথা শুনে হেসে বললেন, বাহ, খুব ভালো নাম তো! কে রেখেছে তোমার এই নাম?আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আমার মা, সার।সার বললেন, দিল্লির একজন বাদশাহর (এত দিনে আমি সেই বাদশাহর নাম ভুলে গিয়েছি) খুব গুণী একজন বেগম ছিলেন, তার নাম ছিল, নূরজাহান।
সারের কথা শুনে আমি আরও লজ্জা পেলাম। মাথা নিচু করে বললাম, আমার মা হয়তো জানতেন না, সার। তাহলে আমাদের মতো গরিব মানুষের নাম এ রকম রাখবেন কেন?
আমার কথা শুনে স্যার হেসে উঠলেন।
এই ডাক্তার মেজর স্যার ছিলেন বাঙালি। আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। কারণ, আমি কাজ করতাম ভালো। আর সকলে ছিল পাঞ্জাবি ডাক্তার। একজন মহিলা ডাক্তারও ছিলেন, তিনিও ছিলেন বাঙালি। তিনি ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির। বেশি কথা বলতেন না।
এদিকে পঁচিশে মার্চের পর থেকে যশোর ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা বেশ থমথমে হয়ে উঠল।
আমরা কানাঘুষোয় শুনতে পেলাম পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকা শহরে খুব গোলাগুলি চলেছে। শত শত মানুষ মারা গেছে। কিন্তু রেডিও বা টেলিভিশনে কোনো কিছু বলছে না, আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম। আমি হাসপাতালের একটু দূরে সুইপার কলোনিতে পরিবারসহ থাকতাম। আমাদের সঙ্গে আরও অনেকে ছিল। সকলেরই তখন জান নিয়ে টানাটানি। কিন্তু পালানোর উপায় নেই। তা ছাড়া ভাবলাম আমরা গরিব মানুষ, হাসপাতালের ময়লা পরিষ্কার করি। আমার আগে আমার মা এই হাসপাতালে কজে করে গেছে। আমাদের তারা কি আর ক্ষতি করবে?
আমি এর আগেই শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছিলাম। সেই যে সত্তরে একটা সাধারণ নির্বাচন হলো, সেই সময় থেকেই আমি মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের কথা শুনতাম। আমি তাঁকে যদিও কোনো দিন চোখে দেখিনি, তবু সকলের মুখে শুনতাম তিনি নাকি খুব লম্বা-চওড়া চেহারার একজন মানুষ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরে থাকেন। হাতকাটা কালো কোট পরেন।
আমি কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে বাঙালি অফিসারদের নিজেদের ভেতরে ফিসফিস করতে দেখতাম। তারা শেখ মুজিবের কথা বলতেন। যখন তারা শেখ মুজিবের কথা বলতেন, তাদের চোখে মুখে একটা আলো জ্বলে উঠতে দেখতাম। একদিন একজন বাঙালি অফিসার আমি একটু দূরে কাজ করছি দেখেও আমাকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের ভেতরে বলে উঠলেন, বঙ্গবন্ধুকে তো এই সব পাঞ্জাবিরা এখনো চিনতে পারেনি, ব্যাটাদের ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন।
কিন্তু ২৫ মার্চের পর থেকে এই সব বাঙালি অফিসারদের ভেতরেও কেমন যেন একটা চিন্তা এসে গেল। কেউ কারও সঙ্গে আর যেন আগের মতো কথাবার্তা বলতেন না। বাইরের কোনো মানুষের সামনে তো নয়ই।
কিন্তু ৩০ মার্চ যখন যশোর ক্যান্টমেন্টে গোলাগুলি শুরু হলো, আমি তখন হাসপাতালের ডিউটিতে ছিলাম। কে বা কারা এভাবে গুলি ছুড়ছে আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু হাসপাতালের সকলে ভয় পেয়ে গেল। আমরা কাজ ফেলে রেখে সকলে আমাদের লেডি ডাক্তারের ঘরের সামনে এসে হাজির হলাম। আমাদের স্টাফরা অনেকে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
আমাদের লেডি ডাক্তার খুব সাহসী ছিলেন। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, ভয় পেয়ো না।
এমন সময় রাত অনুমান দশটার দিকে একদল পাঞ্জাবি সৈন্য আমাদের হাসপাতালে ঢুকে হাসপাতালের মেল উইং এবং ফ্যামিলি উইংয়ের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়া—সকলকে ডেকে নিয়ে বলল, আজ থেকে তোমরা আমাদের হাতে বন্দী। আমাদের হুকুম ছাড়া তোমরা সিএমএইচের সীমানার বাইরে যেতে পারবে না। কেউ যদি এখান থেকে পালাতে চেষ্টা করো, তাহলে সকলকে আমরা গুলি করে মেরে ফেলব।
আমরা তাদের কথার কোনো প্রতিবাদ করলাম না। বরং তাদের হুকুমমতো হাসপাতালে কাজ করতে লাগলাম। এদিকে ঢাকার কোনো খবর পেলাম না। কেউ বলল, বঙ্গবন্ধুকে নাকি গুলি করে মেরে ফেলেছে। কেউ বলল, তাঁকে নাকি বন্দী করে জেলখানায় রেখেছে। এ রকম নানা রকম কানাঘুষো চারদিকে শুনতে লাগলাম। আমরা তখনো জানিনে যে বঙ্গবন্ধুকে তারা বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছে।এদিকে আমাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে তিরিশ তারিখে যে গোলাগুলি হয়েছে, তার ফলে কে যে কোথায় ছিটকে পড়েছে, তার কোনো নাম-নিশানা নেই।
বিগত ২৫ তারিখ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত আমরা সিএমএইচের স্টাফরা মোটামুটি নিরাপদে ছিলাম।কিন্তু ১ এপ্রিল থেকেই পাঞ্জাবি হানাদাররা আমাদের কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতাল বা সিএমএইচে প্রতি রাতে হঠাৎ হঠাৎ করে ঢুকে পড়তে লাগল।
আর যতবার তারা ঢোকে, প্রতিবারই আমাদের মনে হতে লাগল, এইবার বুঝি আমাদের শেষ।অন্তত সাত থেকে আটবার প্রতিরাতে হাসপাতালে ঢুকে আমাদের ধমক দিয়ে বলতে লাগল, কিছু পুরুষ মানুষকে তোমরা হাসপাতালে লুকিয়ে রেখেছ, বের করে আমাদের হাতে দাও।তারা ভাবত আমরা বুঝি ইপিআর বা বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনো বাঙালি সৈন্য বা অফিসারকে আমাদের হাসপাতালে লুকিয়ে রেখেছি।
আমরা তাদের অভিযোগ অস্বীকার করলেও কিছু এসে যেত না। তারা নিজেরা সমস্ত ওয়ার্ডে ও কেবিনে ঢুকে চেক করত। এমনি একেক রাতে সাত থেকে আটবার করে চেক করত। আমরা এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারতাম না।
এর ভেতরে এপ্রিলের ১১ তারিখে ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসংখ্য স্ত্রী-কন্যা ও শিশু আমাদের হাসপাতালে প্রাণভয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে শুরু করল। সেই সাথে প্রচুর বেসামরিক মানুষদের স্ত্রী-কন্যা ও শিশুও আশ্রয় গ্রহণ করল। কেন যে তারা এই সিএমএইচে আশ্রয় গ্রহণ করল, আমি জানি না। হয়তো আর অন্য কোনোভাবে সেই মুহূর্তে তাদের বাঁচবার কোনো পথ ছিল না। প্রাণ ও নিজের শরীরের সম্মান বাঁচাতে তারা দিশেহারা হয়ে নিজের অজান্তেই যেন বাঘের গুহায় এসে আশ্রয় নিল।
এই সব অতীত যখনই আমি ভাবি, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমার চোখের পানি ঝরতে থাকে।
আমার মনে হয়, হায়, আমিও কেন তাদের সঙ্গে মরে গেলাম না!
কিন্তু না, আমাকে বলতে হবে। বাঙালি জাতিকে তার স্বাধীনতার, মুক্তির সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের তাঁদের স্বাধীন দেশের জন্মের কথা জানতে হবে। সে জন্যে আমি সামান্য সুইপার হলেও আমার জীবন অভিজ্ঞতার সেই ভয়াবহ সত্য ইতিহাস আমার পরের প্রজন্ম এবং তারও পরের প্রজন্মকে জানিয়ে রেখে যেতে চাই।
১১ এপ্রিল রাত প্রায় একটার দিকে হানাদার বাহিনী আবার হানা দিল আমাদের হাসপাতালে। তারা আগে থেকেই জানত যে প্রাণভয়ে মহিলা ও শিশুরা এই সিএমএইচে আশ্রয় নিয়েছে। তারা সব ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টেরই পরিবার পরিজন, আর তাদের সঙ্গে কিছু বেসামরিক মানুষের স্ত্রী-কন্যা ও শিশু।
তাদের স্বামী বা ভাইরা কেউ সঙ্গে ছিল না। স্বামীরা হয় গত তিরিশ তারিখের যুদ্ধে মারা গিয়েছিল, অথবা প্রাণভয়ে কোথাও আশ্রয় নিয়েছিল, অথবা তারা পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে ধরা পড়েছিল।
সেদিন হানাদার বাহিনী রাত একটায় সিএমএইচের ফ্যামিলি উইংয়ে ঢুকে একজন নার্সকে ডেকে বলল, আপনাদের এখানে যেসব জেনানা আশ্রয় নিয়েছে, আমরা তাদের এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি।তাদের চেহারা দেখে ভয়ে ভয়ে ডিউটি নার্স বলল, কিন্তু তারা তো এখন ঘুমিয়ে।
এ কথা শুনে একজন হাবিলদার-জাতীয় সৈনিক বিদ্রƒপ করে বলল, মহারানিদের ঘুম ভাঙিয়ে বলুন যে আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি। এখান থেকে তাদের এখন আমরা অন্য জায়গায় নিয়ে যাব। পরে আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
মহিলারা সকলে খালি কেবিনে গাদাগাদি করে পড়ে ছিল। তারাও টের পেয়েছে যে ফ্যামিলি উইংয়ে সৈন্য ঢুকে পড়েছে। তারা সব কান্নাকাটি শুরু করে দিল।
কিন্তু এ কান্না শুনে জালেম পাকিস্তান হানাদারদের মনে কোনো করুণার উদ্রেক হলো না। সিএমএইচের স্টাফরা বাদে সকল মহিলাদেরই তারা একে একে ধরে নিয়ে গেল এবং আর্টিলারি সেকশনে নিয়ে গিয়ে তাদের বিভিন্ন কামরায় আটকে রেখে দিল।
শুনতে পেলাম ছয়-সাতটা আর্টিলারি রুমে গাদাগাদি করে তারা মহিলাদের রেখে দিয়েছে।এবং তারা যাতে পালাতে না পারে সে জন্য পাহারাদার সৈন্যদের বাইরে বসিয়ে রেখেছে।
কিন্তু রক্ষকই যে ভক্ষক, এর প্রমাণ আমরা পরের রাতেই পেলাম। দুজন পাহারাদার সৈন্য তাদের কর্তব্য-কাজ ফেলে অর্থাৎ পাহারা ফেলে রেখে জোর করে একটি ঘরের দরজা ভেঙে সেখানে ঢুকে পড়ল। তারপর তাদের ওপরে অত্যাচার শুরু করে দিল। সেই অত্যাচারের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাদের চিৎকারে সমস্ত সিএমএইচের স্টাফ ও রোগী ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দ দিয়েও প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না।
এই নৃশংস বলাৎকারের পরপরই একজন মহিলার পেট থেকে গলগল করে রক্ত বেরোতে লাগল। তিনি ছিলেন গর্ভবতী। তার গর্ভের শিশু এবং তিনি নিজেও অচিরে মৃত্যুবরণ করলেন।
এরপর চার দিন আর কোনো সৈন্য সেখানে এল না। এই চার দিন তাদের খাবার বা পানি কিছুই দেওয়া হলো না। চার দিন বাদে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় এই সব মহিলাকে যশোর সেন্ট্রাল জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
আমি, নূরজাহান সুইপার, আমি সবকিছু নীরব সাক্ষী হয়ে তাকিয়ে দেখলাম।
আমি তো সেই নূরজাহান ছিলাম না, যিনি ছিলেন মোগল রাজার সম্রাজ্ঞী, যিনি হাতের তালি বাজালে এক ডজন সৈন্য এসে হাজির হতো!
আমি শুধু ফ্যামিলি উইংয়ের মেঝে সোয়াব করতে করতে চোখের পানি ফেললাম।
প্রতিবাদ করার মতো আমার কোনো সাহস হলো না। আমি সামান্য একজন সুইপার, আমার কী সাধ্য আছে যে আমি এর প্রতিবাদ করব?
তা ছাড়া সম্মান হারাবার ভয় তো আমারও ছিল।
মনের ভেতরে কষ্টের ঘা নিয়ে নীরবে আমি সিএমএইচের মেঝে, বাথরুম, টয়লেট পরিষ্কার করতে লাগলাম। বারবার করে আমি হাসপাতালের মেঝে, টয়লেট আর বাথরুম পরিষ্কার করতে লাগলাম। ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘসে ঘসে ওয়ার্ডের মেঝের মোজাইক চকচকে করে তুলতে লাগলাম। রোগী প্রায় হাসপাতালে ছিলই না। শুধু যেসব মহিলার সিজারিয়ান অপারেশন হতো, তারা ভর্তি হতো। তারা ছিল সব পাকিস্তানি মহিলা। তারা সব একে একে পাকিস্তানে ফিরে চলে যাচ্ছিল। যারা গর্ভবতী ছিল, তারা বাচ্চা ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল, তারপর বাচ্চার বয়স এক মাস হতেই তারা সব চলে যাচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে।
আমার মনের ভেতরে একভাবে কান্নার শব্দ হতো। আর যত আমি সেই শব্দ কানে শুনতাম তত আমি ফ্যামিলি উইংয়ের বাথরুম, মেঝে, টয়লেট, টয়লেটের হাই কমোড, প্যান কমোড ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে, ফিনাইল ছিটিয়ে পরিষ্কার করে চলতাম। আমার মনে এতে একটু যেন সান্ত্বনা হতো, সেটা এ রকম যে যেন এই অপরিষ্কার জগতের যত দুর্গন্ধ, যত খারাপ কাজ সব আমি সব নাশ করে ফেলব! জগতের যত পাপ, যত রাহাজানি, যত অবিচার সব আমি এই গন্ধনাশক আর কীটনাশক ব্যবহার করে সাফ করে ফেলব!
আমি জানি, আমি এখন বুঝতে পারি আমার মাথা তখন ঠিক ছিল না, কিন্তু সে সময় এই কাজ করে আমি মনে যেন একটু সান্ত্বনা পেতাম।
বেলা দুটোর সময় কাজ শেষ করে আমি প্রতিদিন বাড়ি চলে যেতাম। কিন্তু প্রায় আমাকে বিকেলে ও রাতেও ডিউটি করতে হতো। কারণ অনেক সুইপার ও ওয়ার্ডবয় সে সময় পালিয়ে চলে গিয়েছিল। হাসপাতালে ছিল তখন একজন বাঙালি লেডি ডাক্তার, দুজন সিস্টার আর তিনজন মাত্র আয়া। এদের সকলকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তারা হাসপাতালের বাইরে যেতে পারত না। তাদের যা কিছু দরকার হতো স্লিপে লিখে অফিসে পাঠাতে হতো, সেখান থেকে সব সাপ্লাই দেওয়া হতো। প্রায় দুই মাস তারা একজন সিস্টারের ঘরের ভেতরে বন্দী হয়ে ছিল। প্রতিরাতেই তাদের ঘরে হানাদার বাহিনী তল্লাশি চালাত। কী যে তারা খুঁজত, আল্লা মালুম। যতবার তারা ঘরে ঢুকত, ততবার তারা বিছানা বালিশ তোশক উল্টেপাল্টে দেখত। টয়লেটে উঁকি মেরে দেখত। কখনোবা টয়লেটের দরজা খুলে রেখে তারা মেয়েদের চোখের সামনেই পেশাব করত।
দুই মাস এভাবে বন্দী থাকার পর সেখান থেকে সিএমএইচের লেডি ডাক্তারের বাড়িতে তাদের আশ্রয় দেওয়া হলো।
আমি প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে যাতায়াত করতাম। এবং ডিউটি শেষে আমার কোয়ার্টারে ফিরে আসতাম। সেখানে আমার স্বামীর মুখে শুনতাম এই পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে বন্দী বাঙালি আফিসারদের ওপরে অত্যাচার করছে। আমাদের সিএমএইচের একজন নামকরা বাঙালি ডাক্তারকে তো তারা এপ্রিল মাসের প্রথমেই তিনি যখন হাসপাতালের ডিউটি করছেন, গুলি করে মেরে ফেলে। প্রকাশ্য দিনের আলোয় তাঁর অফিসে ঢুকে মেরে ফেলে।
এই সব খবর আমরা কানাঘুষোয় শুনতাম আর আমাদের নিজেদের জানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতাম। বাচ্চাদের স্কুলে যেতে দিতাম না। ঘরেই রাখতাম। মাঝে মাঝে আমি ও আমার স্বামী পালাবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। চারপাশে তখন কঠিন নিরাপত্তা গড়ে তুলেছিল হানাদাররা। আবার নীল জামাকাপড় পরা একদল বিহারি লোকদের ঘোরাফেরা করতে দেখতাম হাসপাতালে। তারা নাকি মিলিশিয়া। ফ্যামিলি উইংয়ের সকলে এদের ভয় পেত। এদের ব্যবহার, চাহনি, হাসি সবকিছু আমাদের কাছে অশ্লীল মনে হতো। তারা যখন কোনো কারণে আমাদের ফ্যামিলি উইংয়ে আসত, মেয়েদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকত।
তাদের এই সব নীরব ব্যবহার মেয়েদের মনে যে কত ঘৃণার সৃষ্টি করত, সেটা এখন আর আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। তাদের চোখের সামনে ডাক্তার বা নার্স যে ওজনের, আমার মতো সুইপারও যেন সেই একই ওজনের!
আমরা মেয়েরা যেন সে সময় দোজখের আগুনের ভেতরে বসবাস করতাম। আল্লা সাক্ষী, কতবার করে যে আমার মরতে শখ হয়েছিল তখন।
আমাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টটা বেশ বড় ছিল। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বেশ কয়েকটা বড় বড় পুকুর ছিল। এই সব পুকুরে মাছ ছাড়া হতো। কখনোবা মিলিটারি জোয়ানরা এসব পুকুরে সাঁতার কাটত। আমি প্রতিদিন ফ্যামিলি উইংয়ের কাজ সেরে বাসায় ফিরে যাওয়ার মুখে এসব দেখতাম।
একদিন এ রকম কাজ সেরে বাসায় ফিরছি, ১০ নম্বর পুকুরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি পুকুরের পাড়ে বড় বড় ঘাসের ভেতরে দুজন উলঙ্গ মহিলার লাশ পড়ে আছে। তাদের যে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, সেটা আমি চোখেই দেখলাম। তাদের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্তে ঘাস লাল।
আর দুজন মায়ের পাশে তাদের দুটি শিশুসন্তানও মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। দৃশ্যটা চোখে দেখেই আমার বুক ঠেলে বমি বেরিয়ে এল। আমি হড়হড় করে সেখানে বমি করে ফেললাম। ভাগ্যিস তখন কেউ সেখানে ছিল না। তাহলে হয়তো আমাকেও শেষ করে ফেলা হতো।
এরপরও আমাকে আবার পরদিন ফ্যামিলি উইংয়ে ডিউটি করবার জন্যে যেতে হয়েছে। লুকিয়ে অন্য পথে যেতে হয়েছে।
তবে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক যে ঘটনাটি এখনো আমাকে মাঝে মাঝে রাতের বেলা বিনিদ্র করে তোলে, আমাকে অস্থির করে তোলে, আমাকে পাগল করে তোলে, সেটি বলে আমি আমার এই বক্তব্য এখানে শেষ করতে চাই।
একদিন ভোরবেলা আমি সিএমএইচের মূল চত্বর পার হয়ে ফ্যামিলি উইংয়ের দিকে চলেছি, দেখি এমআই রুমের বারান্দায় অর্থাৎ মেডিকেল ইন্সপেকশন রুমের বারান্দায় একজন বাঙালি তরুণকে শানের মেঝেয় চিত করে শুইয়ে তার শরীরে সুই ঢুকিয়ে ইয়া মোটা একটা সিরিঞ্জে রক্ত তুলে নেওয়া হচ্ছে। তারপর বিকট হাসি হাসতে হাসতে সিরিঞ্জ পুশ করে সেই রক্ত চারপাশে ছিটিয়ে ফেলা হচ্ছে!দেখে আমার শরীরে ভেতরে যেন বিদ্যুতের শক লাগল। আমি স্তম্ভিত হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম। ততক্ষণে অনেকখানি রক্ত তার শরীর থেকে বের করে বারান্দায় ছিটিয়ে ফেলা হয়েছে। যেন রঙের হোলিখেলা চলছে। ছেলেটির মুখ খোলা। শুধু হাত-পা বাঁধা। আশ্চর্য, ছেলেটি চিৎকার করছে না, কান্নাকাটি করছে না, জীবন ভিক্ষা চাইছে না, মুখ থেকে কোনো কাতরোক্তিও প্রকাশ করছে না। শুধু চিত হয়ে শুয়ে সে এমআই রুমের বারান্দার ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে ওখানে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন জোয়ান খুব খারাপ একটা গালি দিয়ে বলল, জমাদারনি, যা, ভাগ।
তার ধমক খেয়ে আমি ত্বরিতে পা চালিয়ে আমার ফ্যামিলি উইংয়ের দিকে হেঁটে যেতে লাগলাম।
তখন পেছন থেকে কানে শুনতে পেলাম, ছেলেটি যেন আমাকেই উপলক্ষ করে বলছে, 'মা, স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না।'
সেদিন বাসায় ফিরে আমি মুখে দানা তুলতে পারলাম না। স্বামীর কাছে বসে অনেকক্ষণ নীরবে কাঁদলাম।আজ এত বছর পরেও, আমাদের এই দেশ যখন সমৃদ্ধির দিকে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, আমার মাঝে মাঝেই সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ে। কার ছেলে, কোত্থেকে এসেছিল, কীভাবে ধরা পড়ল, কিচ্ছু আমি জানিনে, তার সেই শেষ কথাটি এখনো আমার বুকের ভেতরে মাঝে মাঝেই যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটায়, মা, মা, মা, স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম না! দেখে যেতে পারলাম না! দেখে যেতে পারলাম না!
হায়রে বাছা আমার, তুই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলিনে, কিন্তু এই তোরই মতো তরুণদের জীবন বিসর্জনে আমরা তো স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলাম! আমি তো স্বাধীন দেশে আমার ছেলেমেয়েদের বড় করে তুলতে পারলাম। আমার ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলতে পারলাম। সে তো আজ আমি বা আমার স্বামীর মতো সুইপার নয়, সে তো আরও অনেক উন্নত জীবনযাপনের দাবিদার। এসবই তো সম্ভব হয়েছে বাছা তোমাদের মতো তরুণদেরই আত্মত্যাগে। তোমরা আজ যেখানেই থাকো তোমাদের এই গরিব মায়ের মুখে তো স্বাধীনতার হাসি ফুটিয়ে দিয়ে গিয়েছ, শহীদ সন্তানেরা আমার!
১০/০৫/২০
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস থেকে।