Skip to content

Latest commit

 

History

History
62 lines (34 loc) · 10.4 KB

আবার-জোছনায়-আফসানা-বেগম.md

File metadata and controls

62 lines (34 loc) · 10.4 KB


আবার জোছনায়

আফসানা বেগম



গেটের কাছাকাছি আসতেই রাস্তায় দাঁড়ানো তরিকে দেখতে পেল রূপক। তরির সঙ্গে বয়স্ক একজন—বছর দশেক আগে তাদের সাবলেট দেওয়া বাড়ির মহিলা। আন্টিকে চিনতে পেরে রূপক গাড়ি থামাল। হাই বিমের আলোয় চোখ কুঁচকে দুজন তাকিয়ে থাকল। আলোর বিপরীতে রূপককে চিনতে পেরে থমকে গেল তরি। আন্টি চিনলেন একটু পর, ‘আরে, ওই যে গাড়িতে রূপক, সে-ও অনুষ্ঠানে এসেছিল নাকি?’ তরি বুঝল, একই কমিউনিটি সেন্টারের অন্য কোনো অনুষ্ঠানে এসেছিল রূপক। আবছায়ায় তরির বিব্রত মুখ আন্টির চোখে পড়েনি, বললেন, ‘তাহলে খামোখা উবার ডাকতে গেলাম কেন? তোমরাও এখনই বেরোচ্ছ, যেতে যেতে গল্প করা যাবে, কত্ত দিন পরে দেখা!’

আন্টির বিরতিহীন কথার মাঝপথে রূপক এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। তরির অন্যমনস্কতা অগ্রাহ্য করে বলল, ‘কেমন আছেন, আন্টি? বাড়ির দিকেই তো?’ 

‘ভালো, তোমাদের তাড়া নেই নিশ্চয়?’ গাড়িতে উঠে বসার পরে এ কথা বলার মানে নেই। আন্টির হাতে ধরা তরির হাত। মানা তো করতেই পারল না, বরং যন্ত্রের মতো তরি উঠে বসল পাশের সিটে। 

‘সুন্দর গাড়ি। কবে কিনেছ? তোমাদের দেখে আসলে একসঙ্গে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সেই যে তোমরা আমার বাড়িতে এলে, তারপর...’, আন্টির কথার ফোয়ারা ছুটতে লাগল। রূপক প্রায় কথাতেই মাথা দুলিয়ে হাসল। তরি চুপ। কখনো হাসির তোড়ে আন্টির হাতের ধাক্কায় জেগে উঠল। ভেতরে ভেতরে ১০ বছর আগের সময়ে ভ্রমণ। একটামাত্র ঘর নিজেদের, বাকি সব আন্টির সঙ্গে যৌথ মালিকানায়। খাবার ঘরে গল্প জমত। তবে নিজেদের ঘরে গিয়ে দরজা ভেড়ানোর তাড়া মনে লেগেই থাকত। সংসার শুরুর একেকটা ক্ষণ, স্বপ্ন বোনার প্রতিটা মুহূর্ত আর তিল তিল করে টাকা জমিয়ে আস্ত একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়ার সংকল্প—সবকিছু ওখানকার বছর দেড়েক সময়কে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। রাত বারোটায় মহাখালী থেকে মগবাজার বেশিক্ষণ লাগল না। আন্টির গল্প শেষ না হতেই বাড়ি, ‘শোনো, তোমরা মোমবাতির বড়সড় একটা স্ট্যান্ড বারান্দায় ফেলে গিয়েছিলে, মনে আছে? কতবার ফোনও করেছিলাম, নিতে এলে না যে! আজ নেবে?’ 

রাত অনেক, ড্রাইভারকে ছাড়তে হবে—আন্টিকে রূপক বোঝাল। তারপর ড্রাইভারকে চলে যেতে বলে নিজে বসল ড্রাইভিং সিটে। তরি বাধ্য হয়ে পাশে। কৈফিয়তের মতো রূপকের গলা শুনতে পেল, ‘ড্রাইভারের বাড়ি এদিকেই। রাস্তা এখন খালি, আমি অত খারাপও চালাই না।’ তরি এতক্ষণে মুখ খুলল, ‘আন্টিকে বললা না কেন আমরা সেপারেশনে আছি?’

‘বাহ্, তুমি বললেই পারতা?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাইরে তাকাল তরি। অন্ধকারে নানান অবয়ব দেখে চমকে উঠল। কয়েক মিনিটে সে যেমন ১০ বছর আগের হাজার দৃশ্যে ঘোরাফেরা করে এসেছে, রূপকও কি তা–ই? রূপকের দিকে ফিরলে মনে হলো ভাবনার ভারে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। 

‘ধানমন্ডিতেই এখনো, নাকি?’ রূপক প্রশ্ন করল। 

তরি ছোট্ট করে বলল, ‘হুম।’

‘ওই নাফিসও ওখানেই?’

‘মানে?’

‘থাকে না তোমার সঙ্গে?’

‘ফালতু কথা বইল না তো!’

‘ফালতু কেন? ছ্যাঁকা খাইছ নাকি? হা হা হা...’

‘আমাকে ছ্যাঁকা দিবে ও?’

‘বুচ্ছি, তুমিই দিছ। আমাকেও যেমন...’

‘তোমাকে ছ্যাঁকা দিলাম কখন? তুমি নিজেই না সিনথিয়ার সাথে ঘুরাফিরা শুরু করলা! বিয়ে করে ফেল না কেন? ডিভোর্সের প্রসিডিওরও শুরু করো, আমার অত সময় নাই।’

‘করতাম কিন্তু সিনথিয়া তো আমার কলিগকে বিয়ে করে ফেলল।’

তরি মধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে হো হো করে হাসতে লাগল। সামলে নিয়ে বলল, ‘আহা রে, তোমার কী অবস্থা! অফিসে আর মেয়ে নাই? ফেসবুকেও পাও নাই কাউরে?’

‘আমি তোমার মতো অত ঘন ঘন প্রেমে পড়ি না, বুচ্ছ?’

‘উলি বাবা! প্রেম তো তিন মাসের একটা ব্যাপার। তিন মাসের বেশি একই উত্তেজনা থাকে নাকি? মানে, তুমি যেই রকম প্রেম করো—প্রেমিকাকে আগাগোড়া জানা হয়ে গেলে তারপর কিয়ের ইন্টারেস্ট? কৌতূহল একটা প্রেম, এইটা আমি আগে বুঝি নাই।’

ঠেস দিয়ে কথা বলার পরও রূপক কেন যেন চুপ। একলা গাড়ির শব্দ তখন স্তব্ধতা চিরতে লাগল। আরও চিরল রূপকের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, ‘নাফিস আসলেই তোমার সঙ্গে নাই?’

‘আমার কৌতূহল শেষ হইছে, বুচ্ছ?’

রূপক হাসল, ‘আচ্ছা, আমাদের এত কৌতূহল ছিল কেন, বছরের পর বছর?’ রূপকের দিকে তাকাল তরি। অন্ধকারে রূপকের চোখ দেখা না গেলেও তাতে মায়াটুকু ধরতে কষ্ট হলো না। সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুধু কৌতূহল না, মায়াও হয়তো প্রেম।’ 

‘চলো, তোমাকে ওপরে দিয়ে আসি,’ গাড়ি থামিয়ে রূপকের কণ্ঠস্বরে মিনতি। তরি মানা করল না। না হয় আরও কয়েক মিনিট একসঙ্গে কাটুক। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে ব্যাগ হাতড়ে তরি বিরক্ত, ‘বড় ব্যাগের এই এক সমস্যা, ছোট জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় না।’ রূপক চৌকাঠে হেলান দিয়ে চাবির গোছা তরির চোখের সামনে ধরল, ‘এই দেখো, দরজার চাবিটা গাড়ির চাবির সঙ্গে ঝুলতেছে এখনো।’ 

দেড় বছর পরে বিস্মৃত চাবি খুঁজে পেল চেনা দরজা। তরির আগে রূপকেরই হাত পৌঁছে গেল বাতির সুইচে। ‘আন্টির বাড়ি থেকে মোমবাতি স্ট্যান্ডটা আনতে হবে। মোম জ্বালিয়ে মেঝেতে ময়ূরের ছায়াটা দেখব। ওইটাতে ময়ূরের কারুকাজ ছিল, মনে আছে?’

এগিয়ে এল তরি, যতটুকু এগোলে মাঝখানে আর আকাশ থাকে না।